ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সা ক্ষাৎ কা র

মাথায় আইসকুলার নিয়ে সাফে নেমেছিলাম

মাথায় আইসকুলার নিয়ে সাফে নেমেছিলাম

সাখাওয়াত হোসেন জয়

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০

যতটা না পারফরম্যান্স দিয়ে, বিশ্বনাথ ঘোষ তার চেয়ে বেশি আলোচনায় থাকেন মাঠে মেজাজ হারানোর কারণে। তবে বেঙ্গালুরু সাফে বসুন্ধরা কিংসের এ ডিফেন্ডার খেলেছিলেন নিজের চিরচেনা চরিত্রের বিপরীতে। ঠান্ডা মাথায় প্রতিপক্ষ ফুটবলারকে সামলানো, দলকে উজ্জীবিত করা ছাড়াও বিশ্বনাথ এবার তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটিয়েছেন। ২০০৯ সালের পর সাফে বাংলাদেশের সেমিফাইনালে ওঠার অন্যতম কারিগর তিনি। কীভাবে নিজেকে বদলে ফেলেছেন, ভবিষ্যতের স্বপ্নসহ আরও নানা বিষয় নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশ্বনাথ ঘোষ। তা শুনেছেন সাখাওয়াত হোসেন জয়।

সমকাল: বদমেজাজি থেকে একদম কুল। এবারের সাফে বদলে যাওয়া বিশ্বনাথকে দেখা গেছে।

বিশ্বনাথ: একটা সময় সবকিছুই মানুষকে পরিবর্তন করতে হয়। অতীতে দেখা যেত, আমি মাঠে আক্রমণাত্মক ছিলাম। অপ্রয়োজনীয় মাথা গরম করতাম। সিদ্ধান্ত মনঃপূত না হলে রেফারির সঙ্গে বাজে ব্যবহার করতাম কিংবা একটা প্লেয়ারের সঙ্গে লেগে যেতাম। সবকিছু মিলিয়ে দেখা যায়, এটা নিজের জন্যই ক্ষতি, ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসে না। একটা সময় যখন নিজে নিজে উপলব্ধি করলাম, এটা করাটা ঠিক হচ্ছে না। হয়তো আমি টিমের জন্য করি; কিন্তু এটা ওভার রিঅ্যাক্ট হয়ে টিমের জন্য ক্ষতি বয়ে আনে। ঘরোয়া কিংবা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যখনই মাঠে খেলতে নামি, সব সময় আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে যাই। যখন আমি ফোন দিই, তখন প্রথম কথাটাই আমার মা বলেন– বাবা মাথা গরম করা যাবে না। একদম ঠান্ডা মাথায় ফুটবল খেলতে হবে। যদি মাঠে কাউকে মেরেও ফেলে, তোমার সেখানে যাওয়ার দরকার নাই। মারামারি দেখলে আমি চলে যাই। আমার স্ত্রীও শেষ কথাটা বলত আমার মায়ের মতো। যেমন আমি সিশেলসের বিপক্ষে ম্যাচে দেখলাম, আমাদের প্লেয়ার তপু বর্মণকে মারছে। সেটা দেখে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। সাইড বেঞ্চ থেকে দৌড়ে ওদের প্লেয়ারের সঙ্গে ফাইট করেছি। দিন শেষে তো আমার বাংলাদেশ এবং আমার টিমমেট। কেন আমার ভাইকে মারবে; এটা আমি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি না।

সমকাল: এই পরিবর্তন কীভাবে এলো?

বিশ্বনাথ: পরিবারের কারণে কিংবা আমার বন্ধুবান্ধব; সবার কারণেই কিন্তু আমি এখন ঠান্ডা মাথার বিশ্বনাথ। যখনই কথা বলি, তখন সবাই আমাকে বলে মেজাজ হারানো যাবে না। মাঠে ৯০ মিনিট মনোযোগ ধরে রাখতে হবে। এবারের টুর্নামেন্টে দেখা গেছে, ভগবানের কৃপায় মাথা গরম করিনি। সেটার ফলই হয়তো সাফে পেয়েছি।

সমকাল: সেমিফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পর দেখা গেছে মাঠে বসে প্রার্থনা করছেন।

বিশ্বনাথ: আসলে তো আমি কিছুই না। সবকিছুর মালিক ওপরওয়ালা। সবকিছু শেষে ওপরওয়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। যেমন ভালো খেলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পেরেছি। হারি বা জিতি, দিন শেষে আমি ওপরওয়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। এটাই আমি বিশ্বনাথ।

সমকাল: আপনার টিম স্পিরিট দেখে সভাপতি পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার দিয়েছেন। ব্যাপারটা একটু যদি খুলে বলতেন।

বিশ্বনাথ: আমি যে এই টাকাটা পাব, তার আশা কখনও করিনি। আমাদের টিমের যখন সবাই ভালো করছিল, তখন নিজের থেকে ভালো করার চেষ্টা করছিলাম। সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে ড্রেসিংরুমে টিম মিটিংয়ে আমি সবাইকে বলেছি, আজকে যদি ম্যাচ জিতি, তাহলে আমি ব্যক্তিগতভাবে পাঁচ লাখ টাকা বোনাস দেব। এটা কীভাবে যে ভাইরাল হলো, জানি না। এটা আমি শুধু টিমমেটদের বলেছি। আমি জানিয়ে-শুনিয়ে কাউকে বলতে চাই না। আমি চেয়েছিলাম, আমার পকেট থেকে এ রকম বাক্সটা ওদের দেওয়ার। মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম, ফাইনালে উঠলে এ রকম খাম আমি নিজে দেব। প্রথমে ভেবেছিলাম, টিম চ্যাম্পিয়ন হলে পাঁচ লাখ টাকা দেব। যখন ড্রেসিংরুমে গেলাম, টিম মিটিংয়ে গেলাম, তখন বললাম যদি সেমিফাইনালে যাই, তখন পাঁচ লাখ টাকা দেব। হয়তো এই প্লেয়ারদের কাছে ১০-২০ হাজার টাকা কিছু না। নিজের থেকে মোটিভেট করার জন্য ওদের বলেছিলাম।

সমকাল: সে সময় সবার অনুভূতি কেমন ছিল?

বিশ্বনাথ: অনেকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে, আবার অনেকে মজা করেছে। সবাই বলসে– তুই কি সিরিয়াসলি দিবি। তখন আমি বলেছি– হোয়াই নট। আমি তো এখন ফুটবল থেকে কিছু আয় করি। আমার সামর্থ্য আছে। সবাই আমার সঙ্গে মজা করতেছে। তারা বলেছে– কেউ বলে নাই, এই প্রথম কোনো ফুটবলার বলেছে।

সমকাল: পুরো মাঠের মধ্যে আপনি চেষ্টা করেছেন, টিমকে মোটিভেট করতে। টিমমেটদের সঙ্গে কথা বলা, চিয়ারআপ করা...

বিশ্বনাথ: জাতীয় দলে আমার কিন্তু পাঁচ বছর হয়ে গেছে। এখন দিন যাচ্ছে আর সিনিয়র হচ্ছি। একটা সময় অনেক সিনিয়র প্লেয়ার থাকবে না, জুনিয়ররা দায়িত্ব নেবে। ব্যাপারটা আমি ওইভাবে নিইনি। আমি চেষ্টা করেছি, টিমটাকে বুস্টআপ করতে। আমাদের প্লেয়াররা অনেক সময় খেলতে খেলতে মনঃসংযোগ হারিয়ে ফেলে। একজন যদি আমাদের পেছন থেকে কথা বলে বা শাউট করে, তখন হয়তো বা দেখা যায় সে মনঃসংযোগটা ধরে রাখতে পারে। তো সেটাই চেষ্টা করেছি। শুধু আমি না, আমার টিমের প্রত্যেক প্লেয়ারই প্রচুর কথা বলেছেন, যে কারণেই হয়তো বা মাঠে মনোযোগ ছিল। কমিউনিকেশন থাকাটা খুবই জরুরি আমাদের।

সমকাল: সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাফুফে সভাপতি বিশেষভাবে আপনার প্রশংসা করেছেন।

বিশ্বনাথ: এটা খুবই ভালো লেগেছে। তিনি আমাদের ফুটবলের কর্তা এবং গুরু। তাঁর মুখ থেকে প্রশংসা পাওয়া অনেক বড় একটা ব্যাপার। আমি সামনে আরও ভালো করতে চাই। এখন যেভাবে সবার সামনে আমার প্রশংসা করেছেন, ভালো পারফরম্যান্স করে ভবিষ্যতেও এমনটা চাই।

সমকাল: অনেকে বলছেন, পারফরম্যান্স অনুযায়ী র‍্যাঙ্কিংয়ে আমরা সেরা জায়গায় নেই।

বিশ্বনাথ: আমি মনে করি, র‍্যাঙ্কিংয়ে আমরা যেখানে আছি, সেখানে থাকার কথা না। আমরা মাঠে দারুণ ফুটবল খেলছি। র‍্যাঙ্কিংয়ের ওপরের দলগুলোকে হারাচ্ছি, তাতে আমাদের আরও ওপরে থাকার কথা। অনেক টিমের চেয়ে আমরা অনেক ভালো। কী কারণে আমরা এতটা পিছিয়ে গেছি, বলতে পারব না।

সমকাল: এবারের সাফটা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

বিশ্বনাথ: এবারেরটা নিয়ে আমার তিনটা সাফ হয়ে গেছে। আগের দুটিতে জুনিয়র ছিলাম, এখন সিনিয়র হচ্ছি। ম্যাচিউরিটি লাগছে। আশা করি, আগামীতে ভালো করব বা ভালো করার চেষ্টা করব।

সমকাল: ছোট দলের সঙ্গে জিতলে ভালো, না বড় দলের সঙ্গে হারলে ভালো?

বিশ্বনাথ: আমি জিততে পছন্দ করি, হারতে পছন্দ করি না। সেটা হোক ক্লাব কিংবা জাতীয় দল। এটা ঠিক, বড় টিমের সঙ্গে খেললে আমাদের শক্তি বোঝা যায়, যে আমরা কোন লেভেলে আছি। তাই আমি মনে করি, র‍্যাঙ্কিংয়ে ওপরের দলগুলোর সঙ্গে বেশি বেশি ম্যাচ খেলা দরকার। ছোট টিমের সঙ্গে খেললে নিজেদের শক্তি বিবেচনা করা যায় না। 

সমকাল: এই টুর্নামেন্ট কি আপনার সেরা?

বিশ্বনাথ: আমি কীভাবে বলব। আপনারা খেলা দেখেন, আপনারা যারা সাংবাদিক আছেন, তারাই বলতে পারবেন আমি কেমন করেছি। দর্শকরাও এর বিচার করবে। আমার কাছে মনে হয়, এটা আসলে ওই রকম কিছু না। নরমালি যেভাবে খেলি, ওইভাবেই খেলেছি। শুধু এখানে একটা পরিবর্তন ছিল, সেটা হলো আমার মাথাটা গরম ছিল না। বলতে পারেন মাথায় একটা আইসকুলার নিয়ে নামছি। আর শুধু চিন্তা করছি– আমার যে ডিউটি, তা স্বাভাবিকভাবে পালন করে যাব। যদি আমি সহজভাবে তা করতে পারি, তাহলে ভালো কিছু হবে। কোনো উত্তেজনা ছিল না, তাড়াহুড়া ছিল না। একদম স্বাভাবিক ছিলাম।

আরও পড়ুন

×