শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে ৭ রানে হার দক্ষিণ আফ্রিকার
কোহলির রাঙানো শেষে চ্যাম্পিয়ন ভারত

দলের দুঃসময়ে কাণ্ডারি হিসেবে বিরাট কোহলির ৭৬ রানের ইনিংস জয়ের ভিত গড়ে দেয় ভারতের এএফপি
সঞ্জয় সাহা পিয়াল
প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৪ | ০১:০৫
তাদের আনন্দময় সত্তাটুকুতে যন্ত্রণা স্পর্শ করেছিল সূর্যকুমারের হাতে মিলারের ওই ক্যাচটির মধ্য দিয়েই। ১৮ বলে ২২ রানের হিসাব থেকেই ‘চোকার্স’ অপবাদই প্রোটিয়াদের দুর্বল করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা পারেনি প্রথমবারের মতো টি২০ বিশ্বকাপ জিতে নিতে। গতকাল শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৭ রানে হারিয়ে ভারত দ্বিতীয়বারের মতো জিতে নিয়েছে এই শিরোপা। ‘ফাইনালের চোকার্স’ অপবাদ দুর্বল করতে পারেনি রোহিত-বুমরাহদের সঞ্জীবনীকে। ২০০৭ সালে প্রথম এই শিরোপা জিতেছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত। তার পর বহুদিন আলো নিভে ছিল। অবশেষে এদিন বার্বাডোজ থেকে যেন ভারতের নতুন সূর্য উদয় হলো। আবার সূর্যাস্তও বোধ হয় হলো, কেননা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরই বিরাট কোহলি আন্তর্জাতিক টি২০ থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। তৃপ্তির পূর্ণতায় সমাপ্তি ঘটালেন তিনি।
তবে প্রোটিয়াদের সঙ্গে বোধ হয় অবিচারই করল ক্রিকেটের ভাগ্যদেবতা! তা না হলে ১৭৭ রান তাড়া করতে নেমে যারা কিনা ১৫ ওভারে ১৪৭ তোলে, যাদের হাতে কিনা তখনও ৬ উইকেট থাকে; তারা কী করে ম্যাচটি হেরে যায়। যে দলের হয়ে ক্লাসেন ২৭ বলে ৫২ রান করতে পারেন, সে দল কী করে ১৬৯ রানে অলআউট হয়ে যায়। এবারের পুরো আসরে সব ম্যাচেই তারা স্নায়ুর পরীক্ষা দিয়ে সফল হয়েছে। অথচ ফাইনালে এসেই কিনা আতঙ্কিত হয়ে গেল। ম্যাচের পর কাঁদতে দেখা যায় প্রোটিয়াদের কাউকে কাউকে। আসলে এভাবে ভেঙে পড়াটা তাদের কাছে অবিশ্বাস্যই ছিল। ম্যাচের রং বদলে যায় ১৭তম ওভার থেকে। যেখানে হার্দিক পান্ডিয়া এসে ক্লাসেনের উইকেট নেন। পরের ওভারে বুমরাহ এসে জেনসনকে গতি ও লেন্থের হেরফের করে বিভ্রান্ত করেন। দুই আর চার– মোট ৬ রান এসেছিল ১৮ ও ১৯তম ওভারে। ডেথ ওভারে ভারতের এই ত্রিমূর্তির মেধাবী বোলিংয়ের সামনে অসহায় লাগছিল প্রোটিয়াদের। প্রতিটি পরিস্থিতির জন্য কার্যকর বোলার হাতে ছিল ভারতের।
যেমন ছিল ব্যাটিংয়ে। রোহিত রান না পাওয়ায় তাঁর ভূমিকায় ছিল বিরাট কোহলি। ৪৮ বলে ফিফটি যদি হয় ‘কোহলির ইনিংস’, তবে তার পরের ১১ বলে ২৬ রানের ইনিংসটা অবশ্যই বিরাটের! আসলে কোহলির এই মিশ্ররূপের ব্যাটিংয়েই আস্থা রেখেছিলেন ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা। যখন রান পাচ্ছিলেন না কোহলি, তখনও বিশ্বাস হারাননি রোহিত। ‘ফাইনালের জন্য সেরাটা রেখে দিয়েছেন কোহলি’– গতকাল সেটাই দেখল যেন সবাই। কোহলির ৭৬ রানের ইনিংসে ভর দিয়েই ৭ উইকেটে ১৭৬ রান তোলে ভারত। রেকর্ড বলছে, টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে এত রান কখনোই হয়নি। সর্বোচ্চ ১৭৩ রান তুলেছিল অস্ট্রেলিয়া, ২০২১ বিশ্বকাপে।
এদিন শুরু থেকেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে আসা প্রোটিয়াদের চাপে রাখতে চেয়েছিলেন রোহিত শর্মা। ইয়ানসেনের প্রথম ওভারেই ১৫ রান তুলে নেন কোহলি ও রোহিত। প্রোটিয়া স্পিনার কেশব মহারাজকেও মাটিতে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন রোহিত পর পর দুই বাউন্ডারি হাঁকিয়ে। কিন্তু স্কয়ারলেগে ফিল্ডার এনে পাল্টা আক্রমণ সাজান মহারাজও। সুইপ খেলতে গিয়ে সেখানেই ক্যাচ তুলে দেন ভারত অধিনায়ক। মাত্র ৯ রান করে তিনি আউট হয়ে যাওয়ার পর ঋষভ পন্তও সেই সুইপেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনেন। ৩৪ রানে ৩ উইকেট খুইয়ে ভারতের ইনিংস যখন দোদুল্যমান, ঠিক সেখান থেকেই হাল ধরেন কোহলি। পাঁচ নম্বরে নামা অক্ষর প্যাটেলকে বাউন্ডারি মারার খোলা লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেটাই কাজে লাগিয়েছেন, মহারাজকে ছক্কা হাঁকিয়েছেন দারুণভাবে। তাঁর ৩১ বলে ৪৭ রানের ইনিংসটিই ভারতকে স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে আসে। তবে দর্শকরা অপেক্ষায় থাকেন কোহলির ব্যাটের দিকে তাকিয়ে। এই বিশ্বকাপে ফাইনালের আগ পর্যন্ত কোহলি ৮ ম্যাচে করেন ৭৫ রান। সেখানে গতকাল এক ম্যাচেই করেন ৭৬। চারটি চার আর দুটি ছক্কায় সাজানো ছিল তাঁর ইনিংস। কোহলির সঙ্গে দারুণ সঙ্গ দেন শিভম দুবেও। ১৬ বলে ২৭ রান করেন তিনি।
বোলিংয়ের শুরুতে বুমরাহ চাপে ফেলেছিল কিছুটা প্রোটিয়াদের। ১২ রানে ২ উইকেট হারিয়েছিল তারা। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রিজে ডি কক ছিলেন, ততক্ষণ স্বস্তি ছিল না রোহিতদের। অবশেষে ৩৯ রানে ডি কক আউট হতেই নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন কুলদীপরা। তবে এদিন সবচেয়ে খুশি বোধ হয় এই ১১ জনের বাইরে ভারতের এক কুশলীর। তিনি রাহুল দ্রাবিড়। আহমেদাবাদে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে হারার পর অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তাঁর হাত ধরেই ভারত ফের শিখরে চড়ল। খেলোয়াড়ি জীবনে যে কিনা কখনও কোনো আইসিসির শিরোপা স্পর্শ করেননি, সেই দ্রাবিড় কোচ হয়ে অন্তত সেই স্বাদ পেলেন। খুব আবেগি মনে হচ্ছিল তাঁকে, তা হবেনই তো। এই ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকেই তো ২০০৭ বিশ্বকাপে তাঁর অধিনায়কত্ব, তাঁর অর্জন সব ধুলায় মিশে গিয়েছিল। ভাগ্যদেবতা আবার তা ফিরিয়ে দিল।
- বিষয় :
- খেলা-ক্রিকেট