ওহ! মারিয়া

আনহেল ডি মারিয়া
এস এম সাব্বির খান
প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪ | ১৫:৪২ | আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪ | ১৫:৪৫
পৃথিবীর পুরাতন সব পথ একদিন হয়ে যায় ক্ষয়...জানি নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়। সময়ের বহমান স্রোতে জীবনের অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। এমন অনেক প্রিয় মুখ চলে যায় অন্তরালে, যাদের কেউ কোনোদিন হারাতে চায় না। একইভাবে সময়ের সঙ্গে অন্তরালে চলে যাওয়ার সময় এসেছে ফুটবল বিশ্বের এক মহাতারকার। নাম তার আনহেল ডি মারিয়া।
২০০৮ সাল থেকে আকাশী নীল আর সাদার ডোরাকাটা জার্সি গায়ে ফুটবল বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি আর্জেন্টিনার হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন মারিয়া। মেসির মতো রোজারিও থেকে উঠে আসা এই দুরন্ত গতির উইঙ্গার খেলেছেন বেনফিকা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ আর জুভেন্টাসের মতো বিশ্বমানের ক্লাবে। গোল করা আর গোল করানোর মুন্সিয়ানায় দ্য ডার্ক হর্স খ্যাত ডি মারিয়ার হাত ধরে দীর্ঘ শিরোপার খরা ঘুচেছে আলবেসিলেস্তেদের। ইতিহাসে অমর হয়েছেন ফুটবল ইতিহাসের জীবন্ত কিংবদন্তী লিও মেসি। আর সেই অমরত্বের জিয়ন সুধাটিই যেন আনহেল ডি মারিয়া।
আর্জেন্টিনা ফুটবলের পটভূমিতে জন্ম নিয়েছেন অনেক কীর্তিমান। আলবেসিলেস্তেদের প্রসঙ্গ উঠলেই সবার আগে উঠে আসে দুটি নাম- ফুটবল ঈশ্বর খ্যাত ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা আর ফুটবল জগতের বিস্ময়, খুদে জাদুকর লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। এ ছাড়া আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, মারিও আলবার্তো কেম্পেস, বুরুচাগা, ক্যানিজিয়া, পাবলো আইমার, হুয়ান রোমান রিকুয়েলমে, কার্লোস তেভেজ, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, হাভিয়ের মাশচেরানোদের নামও চলে আসে সামনে। তবে ক্যারিয়ারজুড়ে লিওনেল মেসির ছায়ার নিচে থাকা ডি মারিয়ার নামটাও কি আসে না? আসতেই হবে। কারণ ফুটবল বিশ্বের শাসকের যে দণ্ড হাতে মেসি আজ রাজার শাসনে, সেই রাজার মাথার মুকুটটাই যে এল ফিদেও। জাতীয় দলের হয়ে কোপা আমেরিকা, কোপা ফিনালেসিমা এবং কাতার বিশ্বকাপ সব শিরোপাই ছুঁয়ে দেখেছেন মেসি। আর তার প্রতিটি অর্জনে জড়িয়ে আছে তার সুযোগ্য সতীর্থ আনহেল ডি মারিয়ার নাম।
রেকর্ড বলছে, মারিয়া গোল করেছেন, বড় মঞ্চের এমন কোনো ফাইনালেই হারতে হয়নি আর্জেন্টিনাকে। অলিম্পিক থেকে শুরু করে সর্বশেষ ফিফা বিশ্বকাপ। প্রতিটি ফাইনালেই বিজয়ের ঝাণ্ডা হাতে কাপ্তান মেসির রণতরীকে বন্দরে পৌঁছে দিয়েছেন সেনাপতি মারিয়া। সেই বিচারে মেসির পর বৈশ্বিক সাফল্য অর্জনে ইতিহাসের পাতায় ডি মারিয়ার নাম সুনিশ্চিতভাবেই লেখা হয়ে গেছে।
বড় আসরে একের পর এক শিরোপা হাতছাড়া হওয়ার শোকে কাতর আর্জেন্টিনাকে জিয়ন সুধা জুটিয়েছেন আনহেল ডি মারিয়া। ২০২১ কোপা আমেরিকার ফাইনালে বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে চিরপ্রতিন্দ্বি ব্রাজিলের বিরুদ্ধে একমাত্র জয়সূচক গোলটি আসে মারিয়ার জাদুকরী পায়ের ছোঁয়ায়। এই জয়ের মধ্যদিয়ে দীর্ঘ ২৮ বছরের শিরোপা খরা ঘুচিয়ে কোপার রূপালি ট্রফি ঘরে তোলে ম্যারাডোনার উত্তরসূরিরা। পরের বছর ফিনালেসিমার ফাইনালে শক্তিশালী ইতালিকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দেয় আর্জেন্টিনা। লাউতারো মার্তিনেজ আর পাওলো দিবালার সঙ্গে গোল করেন ডি মারিয়াও।
এরপরই আসে ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চ, ফিফা বিশ্বকাপ। লিওনেল মেসির শেষ বিশ্বকাপ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কাতারের সেই আসরে আর্জেন্টিনার শুরুটা হয়েছিল সৌদি আরবের কাছে হার দিয়ে। তবে কে জানত, সেই আসরেই আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের অপেক্ষার পালা ফুরোতে যাচ্ছে? ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের বিপক্ষে অগ্নিগর্ভ ফাইনাল জিতে স্বর্গের সঙ্গে করমর্দন করেন লিওনাল মেসি। বিশ্ব বিজয়ের লক্ষ্য পূরণে তৃপ্ত হন তিনি। আর সেই ম্যাচে গোল করে স্বর্গের দ্বার খুলেছিলেন এই ডী মারিয়া। তারও আগে ২০০৮ সালের অলিম্পিক ফাইনালে গোল করে দলকে পদক জিতিয়েছেন তিনি। আরো একটি শিরোপা জয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সেই ডি মারিয়াকে বিদায় জানাতে হচ্ছে আর্জেন্টিনাকে। ডি মারিয়া কি পারবেন স্বপ্নের মতো তার শেষটাকে অমরত্বের রঙে রাঙিয়ে দিতে?
এই তিন ফাইনালের আগে ‘ফাইনাল’ শব্দটাই ডি মারিয়ার জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছিল। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলতে পারেননি চোটের জন্য। আর্জেন্টিনাকে হারতে হয়ে জার্মানির কাছে। চিলির বিপক্ষে ২০১৫ কোপার ফাইনালের প্রথমার্ধে ফের চোটে পড়লেন ডি মারিয়া। দলেরও স্বপ্নভঙ্গ হলো। ২০১৬ কোপায় গ্রুপ পর্বেই তিনি ইনজুরিতে পড়েন। ফাইনালে একাদশে ফিরলেও দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে আবারও হানা দিল ইনজুরি। মাঠ ছাড়লেন ডি মারিয়া। গোলশূন্য ম্যাচ টাইব্রেকারে জিতে চ্যাম্পিয়ন হয় চিলি।
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে জাতীয় দলের হয়ে মুদ্রার দুই পিঠই দেখেছেন ডি মারিয়া। এবার বিদায় নেওয়ার পালা তার। ফুটবলের মাঠে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে আর আইকনিক হার্ট শেইপড সেলিব্রেশন দেখবে না বিশ্ব। আর্জেন্টাইন সমর্থকদের জন্য এ এক কঠিন মুহূর্ত। সেই লগ্নে দাঁড়িয়ে তাদের মতো হয়তো গোটা বিশ্বের ফুটবল পাগল সমর্থকরা চাইবে, কোপার রূপালি আভায় আলোকিত হোক মারিয়ার শেষটা। জাতীয় দলের হয়ে জীবনের শেষ ম্যাচে মায়ামির মাঠে মায়াবি ফুটবলের মোহমন্ত্রে ভক্তদের বুঁদ করে দিক এল ফিদেও। তবে আগামীকালের ফাইনালে ফলাফল যাই হোক, ফুটবল ইতিহাসের পাতায় যুগ যুগ ধরে লেখা রবে ডি মারিয়ার কীর্তি। বিশ্ব ফুটবলে যতবার উচ্চারিত হবে লিওনাল মেসির নাম ততোবার তার প্রতিধ্বনি হয়ে বাজবে ডি মারিয়ার নামটি। ওহ! মারিয়া। তোমাকে বিদায় জানানোর এই মুহূর্ত বড় কঠিন।
- বিষয় :
- কোপা আমেরিকা-২০২৪
- ডি মারিয়া
- আর্জেন্টিনা