ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার

‘ঋষভকে বলেছিলাম আমাকে হাসাবে না’

‘ঋষভকে বলেছিলাম আমাকে হাসাবে না’

টেস্ট দলের ব্যাটার মুমিনুল হক। ছবি: বিসিবি

সেকান্দার আলী, গোয়ালিয়র থেকে

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪ | ১৩:১৬

ভারতে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সিরিজে যে দু’জন ব্যাটার রান পেয়েছেন, মুমিনুল হক অন্যতম। কানপুর টেস্টে হার না মানা সেঞ্চুরি করেন তিনি। ভারতে প্রথম, বিদেশের মাটিতে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি তাঁর। সব মিলিয়ে ১৩তম। এই সেঞ্চুরি, দলের বাজে পারফরম্যান্স এবং ভারতে টি২০ কৌশল থেকে শেখার অনেক কিছু ছিল বলে জানান মিডলঅর্ডার এই ব্যাটার। ব্যক্তিগত এবং দলের নানা দিক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন মুমিনুল হক। শুনেছেন সেকান্দার আলী।

সমকাল: একটি ভিন্ন রকমের প্রশ্ন দিয়ে শেষ করতে চাই। শুভমান গিল বলছিলেন, আপনার মাথায় বল লাগলেও এলবিডব্লিউর আবেদন করবেন।

মুমিনুল: হাসি...। গিল খুবই মজা করে। পেছন থেকে ব্যাটারদের হাসায়। আগের দিন আমি হোটেলে ওকে বলেছিলাম, ব্যাটিংয়ের সময় আমাকে হাসাবে না। ও তো সেটা মাথায় রেখেছে। একটি বল কোমরে লাগার পর এলবির আবেদন করে। পাশ থেকে সম্ভবত কোহলি বলছিল, ওহু হবে না। তখন ও মজা করে বলছিল, ওর হেলমেটে লাগলেও এলবির আবেদন করব। স্টাম্প মাইক্রোফোনে ওই সাউন্ডই শুনতে পেয়েছেন আপনারা। হাসি...।

সমকাল: ভারতের মাটিতে প্রথম, বিদেশের মাটিতে দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরি। কেমন বাহবা পেলেন?

মুমিনুল: ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা বললে ভালো লেগেছে। কিন্তু যখন আপনি দেশের হয়ে খেলেন, তখন দলই সব। সেখানে আমরা ভালো করতে পারিনি। অর্থাৎ দল হিসেবে খুবই খারাপ খেলেছি। তাই সেঞ্চুরির আনন্দ উপভোগ করতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, এই ইনিংসটি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। এ রকম বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে কখনও খেলিনি। পাঁচজন বোলার পাঁচ ধরনের ছিল। প্রতিটি বোলার আলাদা সময়ে নতুন হুমকি নিয়ে বোলিংয়ে এসেছে। বলে বলে তারা পরিস্থিতির বদল এনেছে। তাদের খেলা খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। যদিও আমি ব্যাটিং করার সময় খুব উপভোগ করছিলাম। কারণ, এ রকম বোলিংয়ের বিপক্ষে কখনও খেলা হয়নি। বিশ্বের সেরা বোলিং মোকাবিলা করে রান করলে ভালো লাগবে স্বাভাবিক। 

সমকাল: সুইপে সুইপে সেঞ্চুরি করেছেন। এত সুইপ শট খেলার কারণ কী? লো বাউন্সের কারণেই কি সুইপ শটের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে?

মুমিনুল: এটি একটি কারণ। আপনি যখন এ রকম ‘টপ ক্লাস’ বিশ্বে এক বা দুই নম্বর বোলিংয়ের বিপক্ষে খেলবেন, তখন আপনাকে কৌশলী হতে হবে। পেস ও স্পিন দুই বিভাগেই তারা সেরা। এসব বোলারের বিপরীতে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছাড়া টিকে থাকা আপনার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। প্রথম টেস্টের পর আমি চিন্তাভাবনা করেছি অপশন খোঁজার। শান্তকে দেখলাম, প্রথম টেস্টে সুইপ খেলে রবিচন্দ্র অশ্বিনকে অকার্যকর করে দিয়েছিল। ওখান থেকে আমি একটা শিক্ষা নিয়েছি। ভালো স্পিনারের বিপরীতে সুইপ শট না খেললে টিকে থাকা কঠিন। ওই শিক্ষা কাজে দিয়েছে। তামিম ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, ও তো ভালো বোলার। তোর নিজের একটা পরিকল্পনা বের করতে হবে খেলার জন্য। নির্দিষ্ট একটা পরিকল্পনা না বের করলে সফল হওয়ার সুযোগ কম। আল্লাহর রহমত ছিল, আমি ওই পরিকল্পনায় সফল হয়েছি; নাও হতে পারতাম।

সমকাল: প্রথম দিন ৪০ রানে ছিলেন। মাঝে দু’দিন খেলা হয়নি। ফোকাস ধরে রাখা যেখানে কঠিন, সেখানে মারাত্মক বোলিংয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছেন। তিন অঙ্কের রানে গেলেন অনেক দিন পর। এই পারফরম্যান্স কতটা স্বস্তির! দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ভালো খেলার প্রেরণা হিসেবে দেখছেন কি?

মুমিনুল: এটা সত্য, লম্বা সময় পর তিন অঙ্কের রান করতে পেরেছি। তবে কি শুধু বড় স্কোরই স্বস্তি দেয় না। ধারাবাহিক রানে থাকা বেশি স্বস্তির। ছোট ছোট বেশ কিছু স্কোর রয়েছে বিগত সিরিজগুলোতে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুটি পঞ্চাশ ছিল। একটিতে অপরাজিত ছিলাম। পাকিস্তানে একটি ৫০, ৩৩ ও ৩৪ রানের ইনিংস ছিল। আমি তাই বড় ইনিংস নিয়ে বেশি ভাবছিলাম না। এভাবে ভাবতে গেলে চাপ চলে আসবে। জোর করে কিছু করতে গেলে অতৃপ্তি চলে আসতে পারে। আমি তাই ওভাবে দেখি না। ভালো কিছু করাই ছিল লক্ষ্য। খেলার আগে আমি যেটা চিন্তা করেছি, কোন বোলারের বিপক্ষে কীভাবে খেলতে হবে। ভারতের বিপক্ষে সেটা কাজে দিয়েছে।

সমকাল: চেন্নাইয়ে কন্ডিশন সচরাচর যেমন থাকে, এবার তার থেকে ভিন্ন ছিল। ওই রকম কন্ডিশনে খেলা কী শিক্ষা দিয়েছে?

মুমিনুল: ভারতের সঙ্গে খেললে অনেক কিছু শেখার আছে। আপনি কীভাবে নেবেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। বোলার ও ব্যাটারদের অনেক কিছু শেখার আছে। আমার যে ইনিংস ছিল, সেখান থেকেই তো অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে নতুন কৌশল নিয়ে খেলতে হয়েছে। শুধু রক্ষণাত্মক মুডে থাকলে হবে না। শট খেলতে হবে। কোন সময় আক্রমণাত্মক হবেন, কোন সময় রক্ষণাত্মক হবেন– এগুলো মাথায় রাখতে হবে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী অ্যাপ্লিকেশন করতে হবে। কোন দিক দিয়ে খেলতে হবে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। গ্যাপগুলো খেয়াল করতে হয়। সুইপ শট খেলার ক্ষেত্রে গ্যাপ বেছে নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বোলারদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় ছিল। ওদের ব্যাটারদের কীভাবে আউট করা যায়, সেভাবে বোলিং করতে পারলে ভালো হতো। আমরা সবাই মিলে পরিকল্পিত গেম খেলতে পারলে কিন্তু সাফল্যের হার বেড়ে যেত। আমরা সমন্বিতভাবে সেটা করতে পারিনি।

সমকাল: কানপুর টেস্টে ভারত টি২০ খেলে জিতে নিল। এভাবে খেলতে পারে ভাবতে পেরেছিলেন?

মুমিনুল: আসলে তারা যেভাবে পাল্টা আক্রমণ করেছে, তা আমি বা আমরা কেউ চিন্তা করিনি। আমি নিশ্চিত, আপনারাও কেউ চিন্তা করতে পারেননি। ওদের আক্রমণাত্মক খেলতে দেখে মানসিকভাবে আমরা অর্ধেক পিছিয়ে পড়েছি। ওরা মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছে। কারণ তারা এমন একটা পরিস্থিতিতে ছিল যে, ঝুঁকি নিয়ে ফেল করলেও ফেরার পথ খোলা ছিল। কারণ, দ্বিতীয় ইনিংসে বেসিক টেস্ট ক্রিকেটে ফিরে যেতে পারত। ভারতের হারার কোনো আশঙ্কা ছিল না। সে কারণেই তারা ওভাবে ঝুঁকি নিয়ে খেলতে পেরেছে। আমরাও ভালো করতে পারিনি। বিশেষ করে উভয় ইনিংসে বাজে ব্যাটিং করেছি। ব্যাটিং খারাপ হলে বোলারদের কিছু করার থাকে না। দেড়শ, দুইশ রান করলে ওই টেস্ট ম্যাচ এগোবে না। ২৩৩ ও ১৪৬ রানে অলআউট হয়ে আমরা বোলারদের জন্য কিছু দিতে পারিনি।

সমকাল: তাহলে কি শিখলেন দ্বিতীয় টেস্ট থেকে?

মুমিনুল: শিখলাম, টেস্ট খেলতে নামার আগে সব ধরনের কৌশল মাথায় নিয়ে নামতে হবে। শুধু ভারত না, যে কোনো প্রতিপক্ষকে ভালোভাবে রিড করতে হবে। কেউই তো চিন্তা করেনি, এভাবে প্রতি আক্রমণ করতে পারে। বিশ্বরেকর্ডের পর বিশ্বরেকর্ড গড়ে ম্যাচ বের করে নেবে! আমার মনে হয়, এই টেস্টের পর থিঙ্কট্যাঙ্কদের ভাবতে হবে, যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ব্যাটার ও বোলারদের প্রস্তুত রাখতে হবে। বিকল্প কৌশলগুলো প্ল্যানে রাখতে হবে। রোহিত শর্মারা কিন্তু দেখিয়ে দিল, এভাবেও টেস্ট খেলা যায়। অনেক দলই এখন এটা ট্রাই করবে। আমরা বুঝতে পারলে এবং তৈরি থাকলে ও রকম ড্যামেজ হতো না।

সমকাল: পাকিস্তানে এত ভালো করার পর ভারতে এমন ব্যর্থতা কতটা হতাশ করেছে?

মুমিনুল: দেখুন, পাকিস্তানে একটি সিরিজ জিতেছি। তার মানে এই নয়, ভারতে এসেও সিরিজ জিতে যাব। যেটা হয়ে গেছে, সেটা হয়ে গেছে। হ্যাঁ, আমাদের একটা আত্মবিশ্বাস ছিল। কিন্তু সেটা ক্লিক করেনি। পাকিস্তানের কন্ডিশন আর ভারতের কন্ডিশনে আকাশপাতাল পার্থক্য। আমরা পাকিস্তানে ভালো ব্যাটিং করেছিলাম। সে অনুযায়ী ভারতে ব্যাটিং করতে পারিনি। ভালো ব্যাটিং করতে না পারলে বোলারদের ব্যাক করা যায় না।

সমকাল: সাকিবের বিদায় নিয়ে কী বলবেন?

মুমিনুল: সাকিব ভাইয়ের যে অবদান, ১৭-১৮ বছর ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য যা করেছে, আমার কাছে মনে হয় না আর কেউ তা করতে পারবে। আর উনার বিকল্প পাওয়া সম্ভব না। উনার জায়গা পূরণ করার নয়। মিরাজের মধ্যে একটা সম্ভাবনা দেখতে পাই। আমি দোয়া করি, মিরাজ কাভার করবে। আমরা সাকিব ভাইকে মিস করব। একজন ক্রিকেটারের ১০ থেকে ১২ বছর শীর্ষে থাকা বিশাল ব্যাপার।

সমকাল: দেশ থেকে সাকিব বিদায় নিতে পারবে বলে মনে করেন?

মুমিনুল: আমি আশা করি, তিনি দেশের মাটিতে শেষ টেস্ট খেলবেন। আমার বিশ্বাস, সে সুযোগ তৈরি হবে।

আরও পড়ুন

×