কামিং হোম, না গোয়িং রোম

জহির উদ্দিন মিশু
প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ জুলাই ২০২১ | ০২:৫৯
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জন ফুট তার ফুটবলবিষয়ক জনপ্রিয় বই 'ক্ল্যাসিকো'য় লিখেছেন ইতালির ফুটবলের রূপ, গুণ আর সৌন্দর্যের কথা। মজার ব্যাপার হলো, ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া ফুটকে আজ্জুরিদের ফুটবল এতটাই টেনেছিল যে, এক নিঃশ্বাসে তিনি ৫৯২ পৃষ্ঠার বই লিখে ফেলেন। আরও অবাক করা বিষয় হলো, ২০০৬ সালে প্রকাশিত হওয়া ক্ল্যাসিকো বইটা ইতালির মানুষ যত না কিনেছিল, তার চেয়ে বেশি ইংলিশরা! যদিও দুই দেশের ফুটবল ঠিক তার উল্টো পথ ধরে এগিয়েছে; অনেকটা শত্রু-শত্রু খেলার মতো। তারাই আজ নামছে ইউরোপসেরার যুদ্ধে। বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় লন্ডনের ওয়েম্বলিতে শুরু হবে ম্যাচটি।
ইটস কামিং হোম, না গোয়িং রোম- দুই দলের ফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পরই বাক্যটা ফুটবলপ্রেমীদের মুখে মুখে। ইংল্যান্ডের মানুষের কাছে ইটস মানে আরাধ্যের ট্রফি। রাশিয়া বিশ্বকাপেও তারা এই ইটসের আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু 'ইটস নট কামিং হোম'। এবার ইউরোয় একই স্বপ্ন সাজিয়ে তাদের অপেক্ষা। ইতালির সমর্থকরা সেটাই একটু নকল করলেন, তারা বলছে ইটস গোয়িং রোম। সেমির ম্যাচে যখন ইতালি ডেনমার্কের মুখোমুখি হয়, তখনও গ্যালারিতে এমন প্ল্যাকার্ডের দেখা মেলে ইতালিয়ানদের হাতে। সে থেকেই দুই ফাইনালিস্টের প্ল্যাকার্ড যুদ্ধটা আরও জমল।
ফুটবলের ঐতিহ্য বয়ে বেড়ানো দুই দেশ প্রথম মুখোমুখি হয়েছিল ৮৮ বছর আগে। সেই যাত্রাটা ছিল দারুণ প্রাণবন্ত, উৎসবমুখর আর স্মরণীয়। ম্যাচটা হবে রোমে, দুই থেকে তিন দিন আগেই প্রস্তুত রোমবাসী। ইংল্যান্ড আসবে শুনে পথঘাটে রঙচঙ, স্টেডিয়ামে বাহারি সাজসজ্জা। তখন ফুটবলের বনেদি এক দল ইংল্যান্ড। মাঠে কেমন করবে তার দিকে না তাকিয়ে তাদের বরণ করায় ব্যস্ত থাকত প্রতিপক্ষ দলগুলো। ১৯৩৩ তারই উদাহরণ হয়ে আছে। প্রীতি ম্যাচ হলেও রোমাঞ্চের পারদ ছিল আকাশসম। ওই ইংল্যান্ড দলে ছিলেন ক্লিপ বাস্তিন, জর্জে হান্ট, থমাস হোয়াইটের মতো ফুটবলাররা। রোমের উদ্দেশে যাওয়ার আগে ভিক্টোরিয়া স্টেশনে দলবদ্ধ হয়ে ট্রেনের অপেক্ষা করছে দলটি। যে দৃশ্য ফ্রেমবন্দি করে কোনো এক ফটোগ্রাফার। ছবির খেলোয়াড়দের দেখলে প্রথমবার আপনার মনে নাও হতে পারে তারা কেউ ফুটবলার। মনে হবে হয়তো কোনো রাজ্যের রাজা বা মন্ত্রী। শুট-কোট-টাই, লম্বা আলখেল্লা আবার হ্যাটও মাথায়। ফুটবল দল পরে বুঝলেও চেনার উপায় নেই কে খেলোয়াড়, কে কোচ। এমনই ছিল ইংলিশদের ঐতিহ্য, বনেদিপনা।
৩৩ সালের পর সব মিলিয়ে ২৫ বারের মতো দেখা হয় দু'দলের। যেখানে ইতালি জেতে ১১ বার। ইংল্যান্ড ৮ বার। আর ৮ ম্যাচ হয় ড্র। তাতে কী বা আসে যায়। ইংলিশদের কাছে ফুটবলটা আরাধনার, বলতে পারেন পূজা করার মতো। শুরুতে তারা ফুটবলকে লালন করেছে মনের গহিনে থেকে। প্রাণভরে দেখেছে বড় স্বপ্ন। অবশ্য যুগ যুগ ধরে সেই স্বপ্নগুলো কেবল ডানাই মেলেছে, পায়নি সেভাবে বাস্তবের দেখা। এক '৬৬-এর বিশ্বকাপই তাদের সব। ওই একটা ট্রফি ইংল্যান্ডের শোকেসে বড় যত্নে সাজানো। তার পাশে সারি সারি সেলফ, প্রতিদিন হয়তো ধুয়েমুছে ঠিকও করা হয়, আরেকটা ট্রফি আসবে বলে। যে অপেক্ষার চার যুগ পেরিয়েও মেলেনি দুইয়ের। এবার সেই সুযোগ ইংলিশদের সামনে, প্রতিপক্ষ ইতালি; যারা কিনা এমন ট্রফি আগেও দেখেছে। শুধু এমন কেন এর চেয়ে বড়টা (বিশ্বকাপ) নিয়েছে চার-চারবার। বলতে পারেন, চ্যাম্পিয়ন তাদের ডিএনএতে। এমন একটি দলের সঙ্গে টক্করে কুলিয়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। অতীতও তাদের সঙ্গী। এর আগে কোনো প্রতিযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ইতালিকে হারাতে পারেনি ইংল্যান্ড। ১৯৬৮-তে ইতালি যখন নিজেদের প্রথম ইউরো জেতে, সেবার ইংল্যান্ডও ছিল ফেভারিট। কিন্তু ফাইনালে ওঠা হয়নি তাদের। টুর্নামেন্টে তৃতীয় হয়ে বিদায় নিতে হয়।
মানচিনির ইতালি আরও ডায়নামিক। হার যেন তাদের এখন দুই চোখের বিষ। কবে হেরেছে বোধহয় নিজেরাও মনে করতে পারবে না। এবারের ইউরোতে আরও দাপুটে ইতালি। সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, স্পেন- কাউকেই পরোয়া করছে না তারা। তাই বলে ইংল্যান্ডকে উড়িয়ে দেবে, সেটাও বিশ্বাস করা কঠিন। রাহিম স্টার্লিং, হ্যারি কেন, ফিল ফোডেন, ম্যাসন মাউন্টরা যেভাবে বল পায়ে আগুন ঝরাচ্ছেন, ইতালি জয়টা অত সহজে পাওয়ার কথা নয়। তবে সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বিবেচনায় আজকের ফাইনালে কাউকেই পরিষ্কারভাবে ফেভারিট বলার সুযোগ নেই। ইতালি উড়তে থাকলেও তাদের মাথায় থাকবে রাজ্যের চাপ। এক. পরিবেশ, পরিস্থিতি ইংল্যান্ডের অনুকূলে। দুই. ওয়েম্বলিতে দর্শকে টইটম্বুর মানে ইংল্যান্ডের লাভ। যেটা মানসিকভাবে যতটা ইংলিশদের চাঙ্গা রাখবে, ঠিক ততটা ইতালিকে চাপে রাখবে। তবু বুদ্ধির খেলায় ইতালির অস্ত্র খুবই ধারালো। ডাগআউটে মানচিনির মতো স্পেশালিষ্ট। মাঠের তারুণ্য আর অভিজ্ঞদের নিয়ে গড়া দলটা যে কোনো পরিস্থিতিতে ঝড়ের রূপ ধারণ করতে পারে। তেমনটা হলে- ইটস গোয়িং রোম।
- বিষয় :
- ইউরো কাপ
- ইংল্যান্ড-ইতালি
- ইউরো ২০২০