ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

ফসল হারিয়ে কাঁদছেন হাওরের কৃষকরা

ফসল হারিয়ে কাঁদছেন হাওরের কৃষকরা

কিশোরগঞ্জ অফিস, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২২ | ২২:৫৬ | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২২ | ০০:৪১

‘যারা বাঁন্দের (বাঁধ) কাম করে তারা পানির অপেক্ষা করে, পানি আইলে বেশি টেকা লুটপাট করা যায়। পানি আইলে কৃষক মরে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি দিয়া যেগুনতে কোটি টেকা কামায়, বাঁন্দ ভাইঙ্গা হাওরে পানি ঢুকনে তারা খুশি অয়। তারা বুঝের বাঁন্দ যখন ভাঙছে, আগামী বছর বরাদ্দ বেশি পাইব।’

কথাগুলো বলছিলেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার সরমঙ্গল ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের কৃষক আব্দুস ছাত্তার। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি জানালেন, ‘বুধবার গভীর রাতে বৈশাখীর বাঁধ ভেঙে দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরের ছয় হাজার হেক্টর জমির ফসল ডুবেছে। বাঁধ নিচের দিকে দুর্বল হয়েছিল, ওপরের দিকে নির্মাণ করা হয়েছে শক্তভাবে; এজন্য নিচের দিক দিয়ে পানি ঢুকেছে। এই বাঁধ ভাঙায় উপজেলার তাড়ল ও জগদল ইউনিয়নের হাজার হাজার কৃষকের সর্বনাশ ঘটেছে।’ এই বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি। 

উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নদ-নদীতে পানি বাড়ায় ফসলরক্ষা বাঁধ নিয়ে ভুগছেন সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওরের কৃষক। পানি বেড়ে হাওর তলিয়ে যাওয়ায় ফসল হারিয়ে কাঁদছেন সুনামগঞ্জের কৃষকরা। অনিয়ম-দুর্নীতি করে দুর্বল বাঁধ নির্মাণের বিষয় নিয়ে চলছে তোলপাড়। তবে ২৪ ঘণ্টায় নদ-নদীতে পানি কিছুটা কমেছে। আসাম ও মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি না হলে পানি বাড়ার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা। তবুও আতঙ্ক কাটেনি হাওরের কৃষকের। দুর্বল বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।

পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার ক্ষতিগ্রস্ত চন্দ্রসোনার থাল হাওর পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বলেন, হাওরের বাঁধের কাজে অনিয়মের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি সুনামগঞ্জে এসে সুষ্ঠু তদন্ত করবে। হাওরের বাঁধের কাজে কোনো সরকারি কর্মকর্তা কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) অনিয়মে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া নেওয়া হবে।

বুধবার রাত পর্যন্ত জেলার প্রায় দেড়শ ছোট-বড় হাওরের মধ্যে ১২টির ফসল উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে ডুবেছে। বেশিরভাগ হাওরে পানি ঢুকেছে বাঁধ ভেঙে। সুনামগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীর ষোলোঘর পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার দশমিক ৫৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

এদিকে নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার হাওরের কীর্তনখোলা বেড়িবাঁধ মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। খালিয়াজুরী ইউএনও এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম জানান, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, পাউবো ও এলাকাবাসী বাঁধে রয়েছে। স্থানীয় কৃষকদের সহায়তায় বাঁশ, কাঠ, মাটি দিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

নেত্রকোনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এ এল সৈকত বলেন, মঙ্গলবার ধনু নদীর পানি বিপৎসীমার মধ্যে থাকলেও বুধবার থেকে কিছুটা কমেছে। তবে পানির চাপে কীর্তনখোলা বাঁধের তিনটি পয়েন্ট ধসে যায়। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এখন পর্যন্ত বাঁধ টিকিয়ে রাখা হয়েছে। দুই থেকে তিন দিন এভাবে থাকলে হাওরের ধান রক্ষা করা যাবে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত জেলায় কোথাও বাঁধ ভাঙেনি।

অপরদিকে কিশোরগঞ্জ পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম বলেন, দুই দিন আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং কোথাও বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত হাওরে তিন থেকে সাড়ে তিন সেন্টিমিটার পানি কমেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্জল সাহা জানান, আগামী ৭২ ঘণ্টায় মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে তেমন বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। তাই জেলার ধনু, সুরমা, বাউলাই, কালনীসহ প্রধান নদীগুলোর পানি সার্বিকভাবে কমতে পারে।

হাওরের ফসল রক্ষায় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। দলটি বলেছে, দ্রুত বাঁধের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে না পারলে হাওরের পরিস্থিতি হবে ২০১৭ সালের বিপর্যয়ের মতো। এখনই ফসল রক্ষার উদ্যোগ না নিলে কৃষকরা যেমন সর্বস্বান্ত হবেন, তেমনি এই পরিস্থিতি দেশে গুরুতর খাদ্য সংকট তৈরি করতে পারে। সিপিবির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান।

জাতীয় কৃষক সমিতির সভাপতি মাহমুদুল হাসান মানিক ও সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম গোলাপ পৃথক বিবৃতিতে হাওর অঞ্চলে হাজার হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান পাহাড়ি ঢলে ভেসে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ায় উদ্বেগ জানিয়েছেন। অবিলম্বে নতুন বাঁধ নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত ও ঋণগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার আহ্বান জানান তারা।

আরও পড়ুন

×