ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

গোলাপিদের আনন্দের দিন

গোলাপিদের আনন্দের দিন

সিংড়ার আনন্দনগরে মরা আত্রাই নদীতে তৈরি বাঁশের তৈরি চওড়া সাঁকো পার হওয়ার সময় বৃহস্পতিবার বিজয় চিহ্ন দেখায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা- সমকাল

নবীউর রহমান পিপলু, নাটোর

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০

ছোট্ট সোনামণিরা লাইন ধরে সাঁকো পাড়ি দিতে শুরু করল। কয়েকজন কোনোমতে পার হয়। গোলাপি, রেহান পারল না। সাঁকোর মাঝামাঝি এলে তারা পড়ে যায় পানিতে। সাঁতরে তীরে উঠলেও তাদের বই-খাতা ভিজে একাকার হয়ে যায়। ঘটনাটি গত ২৩ মার্চের নাটোরের সিংড়া উপজেলার আনন্দনগর-কৃষ্ণনগর গ্রামের।
গোলাপিদের বিদ্যালয়ে যাতায়াতের সেই কষ্টের দিন আপাতত ফুরাল। সেদিনের ঘটনা সমকালে ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হলে দুর্ভোগের কথা জানাজানি হয়। উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধি ছুটে যান সেখানে।
শিশুদের ঝুঁকিমুক্ত নদী পারাপারে উপজেলা পরিষদ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। উপজেলা চেয়ারম্যান নদীতে বাঁশের সাঁকো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। গত ৪ এপ্রিল শুরু হয় সাঁকো তৈরির কাজ। টানা তিন দিন কাজ করেন ২০ জন শ্রমিক। এতে ব্যয় হয় ৩৭ হাজার টাকা। তবে মরা আত্রাই আনন্দনগর-কৃষ্ণনগরকে ভাগ করলেও সাঁকো তৈরিতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন গ্রাম দুটির বাসিন্দারা। প্রায় দেড়শ ফুট দৈর্ঘ্য এবং সাড়ে তিন ফুট চওড়া চাঁটাইয়ের সাঁকোটি তৈরিতে ৭৪টি বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সাঁকোটি খুলে দেওয়া হয়। কোমলমতি শিশুরা সাঁকোটি পার হয়ে স্কুলে যায়। এ সময় তারা রাজ্য জয় করার মতো বিজয় চিহ্ন (ইংরেজি অক্ষর ভি) দেখায়।
আনন্দনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী গোলাপি খাতুন ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র রেহান বলে, সাঁকো হওয়ায় এখন স্কুলে যেতে আর সমস্যা হবে না তাদের। নদীতে পড়ে যাওয়ার আর কোনো ভয় নেই।
গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আয়নাল হক বলেন, জীবনের শেষ সময়ে এসে নদী পারাপারের এই ব্যবস্থা দেখে ভালো লাগছে। যারা করেছে তাদের আল্লাহ ভালো করবেন। এখন নাতি-পুতিদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
গ্রামবাসী জানায়, এখানে আগে কোনো সাঁকো ছিল না। পাতিলে বইপত্র ও পোশাক নিয়ে সাঁতার কেটে নদী পার হতো। ওপারে গিয়ে পোশাক পাল্টে বিদ্যালয়ে যেত শিক্ষার্থীরা। নদী পারাপারের দুরবস্থা দেখে গত ১৭ মার্চ বাঁশের সাঁকো করে দেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান।
গ্রাম দুটিতে প্রায় আট হাজার মানুষের বসবাস। শত কষ্ট ও ঝুঁকি সত্ত্বেও থেমে নেই তাদের জীবন সংগ্রাম। শত শত শিক্ষার্থী যেভাবে পড়াশোনা করছে, রীতিমতো বিস্ময়কর।
আনন্দনগর গ্রামের বাসিন্দা ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র লেকচারার মো. আহসান হাবিব হাসান বলেন, নদীতে সাঁকো হওয়ায় খুব খুশি হয়েছেন তিনি। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪৯ বছর পর বাঁশের সাঁকো নির্মিত হলো। এটি অস্থায়ী হলেও মানুষের কিছুটা দুর্ভোগ লাঘব হয়েছে। দুই গ্রামের উন্নয়নে এই সরকারের কাছে নদীতে একটি সেতু নির্মাণের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানের দাবি জানান তিনি।
কৃষক আব্দুল জলিল, আল আমিন, মোজাফ্‌ফর, মজিবর, আমেনা বেগম ও রোজিনা বেগম জানান, এখানে বাঁশের সাঁকো হওয়ায় খুব উপকার হয়েছে তাদের। স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে একটি সেতু চান এই নদীর ওপর।
প্রধান শিক্ষক মো. লোকমান হাকিম বলেন, পারাপারের ব্যবস্থা না থাকায় শিশু শ্রেণির অনেকেই স্কুলে আসা বন্ধ করেছিল। অভিভাবকরা তাদের স্কুলে আনতেন না। সাঁকো হওয়ার পর অভিভাবকদের অনেকেই তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর কথা বলে গেছেন। এই ব্যবস্থা অস্থায়ী হলেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করবে।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, সাঁকোটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার পর কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে। তারা গতকাল সকাল ৯টার আগেই সাঁকোর কাছে এসে ভিড় করে। এটি সাময়িক ব্যবস্থা হলেও প্রথমবারের মতো একটি বাঁশের সাঁকো হওয়ায় নদীর দুই পাড়ের মানুষ খুব খুশি হয়েছে।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আলী আশরাফ বলেন, উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে তৈরি এই ব্যবস্থা অনেকাংশে উপকার হয়েছে।
উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এলাকার মানুষের কথা বিশেষ করে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষাজীবনের কথা ভেবে সাঁকোটি করা হয়েছে। এটি স্থায়ী ব্যবস্থা না হলেও কয়েক মাস পারাপার করতে পারবে সবাই। তবে ভরা বর্ষায় এই সাঁকোও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। তখন নৌকাতে করে পারাপার হতে হবে।
উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, বিএডিসি নদীর এই স্থানে রাবার ড্যাম করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ে। এখানে রাবার ড্যাম হলে আবাদি জমিতে সেচসহ পারাপারের স্থায়ী ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে।

আরও পড়ুন

×