রূপসায় ব্যতিক্রমী উদ্যোগ
আলো ছড়াচ্ছেন আলমগীর

মামুন রেজা, খুলনা
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২০ | ১৪:০৪
খুলনার রূপসা উপজেলার নৈহাটী ইউপি সদস্য এস এম আলমগীর হোসেন শ্রাবণ। নিজ
কর্মগুণে একজন সাধারণ ইউপি সদস্য থেকে অসাধারণ হয়ে উঠেছেন তিনি। তার
কার্যক্রমে এলাকার মানুষ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যরাও খুশি। তাদের
কাছে আলমগীর এখন একটি গর্বের নাম। মূলত এই ইউপি সদস্যের পাঁচটি ব্যতিক্রম
উদ্যোগই এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তিনি প্রতিবন্ধী শিশুদের
জন্য যেমন স্কুল করেছেন, তেমনি প্রতিষ্ঠা করেছেন আদবকায়দা শেখানোর স্কুলও।
যুবসমাজকে মাদক থেকে দূরে রাখতে গড়ে তুলেছেন ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, নিজে
ভ্যান চালিয়ে আগ্রহীদের মাঝে সেই বই বিতরণ করেন। পরিবেশ সুরক্ষায় গাছের
প্রতিও আলমগীরের রয়েছে অগাধ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা থেকেই এরই মধ্যে রোপণ
করেছেন ১০ হাজারের বেশি গাছের চারা। এছাড়া বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে অনেক
নারীকে করেছেন স্বাবলম্বী।
রূপসার দেবীপুর গ্রামে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৩০ শতক জমিতে ২০১৭ সালের আগস্টে
প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন আলমগীর। প্রতিষ্ঠানের নাম
দেন 'আলো ফুটবেই মো. সালেহীন প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র'।
এখানে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮১ এবং শিক্ষক
১৭ জন। প্রথম শিফট সকাল পৌনে ১০টা থেকে দুপুর ১২টা এবং দ্বিতীয় শিফট দুপুর
১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত। শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনা-নেওয়ার জন্য রয়েছে
৬টি ভ্যান। ফিজিওথেরাপির পাশাপাশি শিশুদের সবার জন্য রয়েছে দুপুরের খাবার।
কিসমত ফুলতলা গ্রামের বাসিন্দা মাছ বিক্রেতা কামরুল ইসলাম জানান, তার ছেলে
জোবায়ের প্রতিবন্ধী। তবে এখন সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। এখানকার শিক্ষকরা
ভালোভাবে লেখাপড়া শেখান এবং পরিচর্যা করেন। তিনি জানান, ফিজিওথেরাপির
মাধ্যমে এখানকার বেশ কয়েকটি প্রতিবন্ধী শিশু এখন হাঁটাচলা ও কিছুটা কথা
বলতে পারে।
আলমগীর বিএল কলেজ থেকে ২০০৯ সালে ইতিহাসে স্নাতক পাস। তিনি সমকালকে বলেন,
বিনামূল্যে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাদান ও পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে স্কুলটি
গড়ে তুলি। প্রতিবন্ধী শিশুদের সঠিক সময়ে পরিচর্যা দিয়ে তাদের স্বাভাবিক
জীবনে আনা সম্ভব। সরকারি কোনো সহযোগিতা ছাড়াই তিনি স্কুলটি পরিচালনা করছেন।
শিক্ষকদের সম্মানী ও কর্মচারীদের বেতনসহ স্কুলের অন্যান্য খাতে প্রতি মাসে
ব্যয় হয় প্রায় ৮০ হাজার টাকা। নিজের ১০ বিঘার মাছের ঘের ও মাটির টাইলসের
ব্যবসার আয় থেকে অর্থের জোগান দেন তিনি।
স্কুলটির দারোয়ান মোশারফও শারীরিক প্রতিবন্ধী। তিনি বলেন, এখানে চাকরির আগে
ভিক্ষা করতাম। একজনের বাড়িতে থাকতাম। আলমগীর ভাই ভিক্ষা থেকে সরিয়ে
বিদ্যালয়ে এনে কাজ দিয়েছেন।
শিশু শিক্ষার্থীদের ভ্যানে বিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া করেন মোহাম্মদ আলামিন শেখ।
তিনি বলেন, ২০০৬ সালে দুর্ঘটনায় ডান হাত হারাই। শিক্ষার্থীদের পরিবহনের কাজ
দিয়েছেন আলমগীর ভাই।
একই বছর নৈহাটী গ্রামে ৩-৪ বছর বয়সী শিশুদের জন্য একটি ব্যতিক্রমী স্কুল
গড়ে তোলেন আলমগীর হোসেন। 'আলো ফুটবেই বিদ্যালয়' নামের এ প্রতিষ্ঠানে কক্ষ
রয়েছে ৩টি। এখানে শিক্ষার্থী রয়েছে ৬০ জন এবং শিক্ষক ৬ জন ও একজন কর্মচারী।
এখানে অক্ষরজ্ঞান ও আরবি পড়ানোর পাশাপাশি শেখানো হয় আদব-কায়দা। শেখানো হয়
ব্রাশ করা, খাওয়ার আগে হাত ধোয়া, যেখানে-সেখানে ময়লা না ফেলা, খেলাধুলা,
রাস্তার কোন পাশ দিয়ে হাঁটতে হবে, কারও সঙ্গে দেখা হলে সালাম দেওয়া, মাটি
দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি। আরও শেখানো হয় ছড়া, গান, গজল ও জাতীয় সংগীত।
বিনামূল্যে শিশুদের দেওয়া হয় সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার। স্কুলটিতে মাসে
ব্যয় হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা, সব টাকাই জোগান দেন আলমগীর হোসেন।
জ্ঞানের আলো ছড়াতে ২০১৬ সালে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি গড়ে তোলেন এই ইউপি
সদস্য। সাড়ে তিন বছর ধরে নিজে ভ্যান চালিয়ে বই পৌঁছে দিচ্ছেন আগ্রহীদের
মাঝে। তার লাইব্রেরিতে বই রয়েছে ১ হাজার ২০০টি। যারা আগ্রহী প্রথমে তাদের
লাইব্রেরির কার্ড করে দেন আলমগীর। যে কেউ বই নিয়ে ২ সপ্তাহ ধরে পড়তে পারেন,
পরে বই ফেরত দিতে হয়। কার্ড করার জন্য কোনো ফি নেই, নেই কোনো জামানত। তার
লাইব্রেরির সদস্য হয়েছেন প্রায় ৪০০ জন।
ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিতে ইউনিয়ন পরিষদের নাগরিকত্ব সনদ, চারিত্রিক সনদপত্র,
জন্মনিবন্ধন ও মৃত্যুর সনদপত্রসহ সব ফরম রাখেন আলমগীর। গ্রামের মানুষ সহজেই
সংগ্রহ করতে পারে এসব সনদপত্র। আলমগীর হোসেন জানান, এলাকার যুবকদের মাদক
থেকে দূরে রাখতে তাদের বই পড়ানোর জন্য তিনি এই লাইব্রেরি করেন।
গত বছর নৈহাটী ইউনিয়নের ১০টি গ্রামে ১০ হাজারের বেশি গাছের চারা রোপণ
করেছেন এই ইউপি সদস্য। রাস্তার পাশে এবং বিভিন্ন লোকের বাড়ির আঙিনায় লাগানো
হয়েছে এসব গাছের চারা। এর মধ্যে রয়েছে ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ। স্থানীয়
নারীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন চারা লাগাতে।
আলমগীর হোসেন ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে খেজুরের পাতা দিয়ে স্যান্ডেল ও
ভ্যানিটিব্যাগ তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন নৈহাটী গ্রামের ৬০
জন নারীকে। প্রতিটি স্যান্ডেলের দাম ৩০০ টাকা এবং ব্যাগের ৫০০ টাকা।
প্রশিক্ষণ পাওয়া নারীরা বাড়িতে বসেই এসব স্যান্ডেল ও ব্যাগ তৈরি করেন।
এ বিষয়ে নৈহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বুলবুল বলেন,
আলমগীরের কাজে ইউনিয়ন পরিষদের সবাই গর্বিত। তিনি সমাজ ও দেশের ভালো করছেন।
তরুণদের মনোভাব বদলে দিচ্ছেন।
- বিষয় :
- ব্যতিক্রমী উদ্যোগ