চট্টগ্রাম
র্যাবের ওপর হামলা নিয়ে সব পক্ষের রাখঢাক

সারোয়ার সুমন ও আবদুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৭ মে ২০২২ | ১৪:৫২
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে র্যাবের ওপর হামলায় ছাত্রলীগের এক নেতা নেতৃত্বে ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত বুধবার সন্ধ্যায় উপজেলার বারইয়ারহাটে হামলার শিকার হন র্যাব সদস্যরা। ডাকাত ডাকাত বলে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। ওই ছাত্রলীগ নেতার নাম তানভীর হোসেন ভূঁইয়া। তিনি ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার ঘোপাল ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি বলে জানিয়েছে র্যাব। তাঁর কাছ থেকে মাদক উদ্ধারে গিয়ে হামলার শিকার হন র্যাব সদস্যরা। তানভীর মাদকসহ নানা অপরাধের নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে পরিচিত। বারইয়ারহাট ও ফেনীর ছাগলনাইয়ার ঘোপাল ইউনিয়ন পাশাপাশি।
হামলার ভিডিওটি চার মিনিটের। এতে দেখা যাচ্ছে, শত শত মানুষ ঘিরে রেখেছে তিন ব্যক্তিকে। তাঁদের মধ্যে দু'জন র্যাব সদস্য। তবে তাঁদের গায়ে নেই র্যাবের পোশাক। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ লাঠি হাতে, কেউ কিল-ঘুষি দিয়ে গণপিটুনি দিচ্ছে তাঁদের। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁরা পড়ে আছেন রাস্তার পাশে। তাঁদের পাশে আছে সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার। সেটিও ভাঙচুর করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ভিডিওটি। আহতদের মধ্যে দুই র্যাব সদস্যের অবস্থা গুরুতর। রাতেই হেলিকপ্টারে করে তাঁদের নেওয়া হয়েছে ঢাকায়। সেখানে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে মুখ খুলছে না স্থানীয় পুলিশ। এ ঘটনায় গতকাল শুক্রবার রাতে মিরসরাই থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। এতে ১৭ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় ৬০-৭০ জনকে আসামি করা হয়েছে। ১৩ জনকে আটক করা হয়েছে বলে গতকাল জানিয়েছে র্যাব। তাদের মধ্যে সাইদুর নামে এক ব্যক্তি রয়েছে, যে আহত র্যাব সদস্যের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় অস্ত্র।
তবে এ ঘটনায় এখনও মেলেনি অনেক প্রশ্নের উত্তর। সাদা পোশাকে আসলে কোথায় যাচ্ছিলেন র্যাবের দুই সদস্য? গোয়েন্দা তথ্য নিতে যদি তাঁরা মিরসরাইয়ে যান, সে তথ্য আগে ফাঁস হলো কী করে? স্থানীয়রা ঘটনার সঙ্গে একটি কাভার্ডভ্যানের যোগসূত্রের কথা বলছে। এ কাভার্ডভ্যান কেন আটক করা গেল না? ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরও কেন আইনের আওতায় আনা হলো না- এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা। সমকালের পক্ষ থেকে র্যাব, পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু স্পষ্ট করে কোনো কথাই বলা হচ্ছে না। তবে আইনজ্ঞরা মনে করছেন, এটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, এ ঘটনার নেপথ্যে থাকতে পারে অন্য কোনো বিষয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য তাঁরা এটি ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে বলছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, সাধারণত গোয়েন্দারা দুইভাবে কাজ করে। ছদ্মবেশে ও আন্ডার কাভারে (আড়ালে থেকে গুপ্তচরবৃত্তি)। কোনো প্রশিক্ষিত সদস্য এভাবে কাজ করলে তাঁর পরিচয় প্রকাশ হওয়ার কথা নয়। এখানে তাঁরা কোনো আইনি কাজে গিয়েছে কিনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনস্বার্থ কিংবা জনকল্যাণের স্বার্থে সেখানে গিয়েছিল কিনা, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আমরা এ ধরনের ঘটনা আগেও অনেক জায়গায় ঘটতে দেখেছি। আসলে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ নাকি ভিন্ন কিছু আছে, তা ভালো করে তদন্ত করা উচিত নিরপেক্ষ সংস্থা দিয়ে।
তবে রথ্যাব-৭-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ ইউসুফ সমকালকে বলেন, যারা মাদকের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন, তাঁরা রথ্যাবের গোয়েন্দা দলের সদস্য। এ কারণে তাঁদের গায়ে সাদা পোশাক ছিল। এ সময় পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। র্যাব যখন কোনো অভিযান পরিচালনা করে, তখন উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে পোশাক পরেই করা হয়। এখানে অভিযানের বিষয় ছিল না। আহত রথ্যাব সদস্যদের শারীরিক অবস্থা জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁদের আইসিইউতে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার আগে তাঁদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছেন না চিকিৎসকরা।
এদিকে, রথ্যাব সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনার পর গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হলে ঘটনাস্থল ও এর আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। গতকালও রথ্যাব-পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেছে। গত বুধবার সন্ধ্যায় মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট পৌর বাজারের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে 'ডাকাত' সন্দেহে একটি প্রাইভেটকারে সাদা পোশাকে থাকা র্যাব সদস্যদের ওপর হামলা চালায় দুস্কৃতকারীরা। এতে তিনজন আহত হন। তাঁদের মধ্যে শামীম ও মোখলেস নামে দুই রথ্যাব সদস্য রয়েছেন। ভাঙচুর করা হয় প্রাইভেটকারটিও। হামলার খবর পেয়ে পুলিশ ও রথ্যাব সদস্যরা তাঁদের উদ্ধার করে ফেনী জেলা হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে হেলিকপ্টারে ঢাকার সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়।
যেভাবে তৈরি করা হলো গণপিটুনির মঞ্চ: র্যাব-৭-এর দাবি, তাঁরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারেন কুখ্যাত কিছু মাদক ব্যবসায়ী মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে মাদকদ্রব্যসহ চট্টগ্রাম জেলার জোরারগঞ্জ থানাধীন ধুমঘাট এলাকার ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের পাশে অবস্থান করছে। এটা জানতে পেরে র্যাবের একটি টিম ঘটনাস্থলে যেতে চাইলে মাদক ব্যবসায়ীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে র্যাবের গাড়িকে রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা করে। সেখানে তারা ব্যারিকেড দিতে ব্যর্থ হলে পরে জোরারগঞ্জ ফুট ওভারব্রিজের নিচে দুটি কাভার্ডভ্যান রেখে রাস্তা বন্ধ করে 'ডাকাত ডাকাত' বলে গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে পূর্বপরিকল্পিতভাবে র্যাবের ওপর সশস্ত্র হামলা করে।
ঘটনার পর মাদক ব্যবসায়ী ও দুস্কৃতকারীদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে ব্যাপক গোয়েন্দা নজরদারি এবং গভীর ছায়াতদন্ত শুরু করে র্যাব। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৭ চট্টগ্রাম জেলার জোরারগঞ্জ এবং ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানাধীন বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৩ জনকে আটক করা হয়। তারা হলো সাইদুর রহমান সাঈদ, আনোয়ার হোসেন, এসএম শাফায়েত হোসেন, মিনহাজুল ইসলাম ওরফে মিঠু, শহিদুল ইসলাম ওরফে আকাশ, সোয়েব উদ্দিন আবির, সাইদুল ইসলাম সুমন, নাহিদ উদ্দিন, আবু সাঈদ, নাসির উদ্দিন, মাঈন উদ্দিন, ইমাম হোসেন, ফাহাদ ওরফে ফরহাদ।
অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছিল সাইদুর: ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে র্যাব জানায়, সাইদুর রহমান সাঈদ ঘটনাস্থল থেকে একজন র্যাব সদস্যের কাছ থেকে একটি অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে সাঈদের দেওয়া তথ্যমতে এসএম শাফায়েত হোসেনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়। এদিকে, আটক ফাহাদের প্যান্টের পকেট থেকে ২ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে র্যাব। তার দেখানো ও শনাক্ত মতে একটি বস্তার ভেতর থেকে পরে ৫২ বোতল ফেনসিডিল ও এক কেজি গাঁজাও উদ্ধার করা হয়।
গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস হলো কীভাবে: র্যাব বলছে, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে মিরসরাইয়ে গিয়েছিলেন র্যাব সদস্যরা। সেটি আগেভাগে জানতে পেরে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে ডাকাতের গুজব তুলে হামলা করা হয়েছে র্যাব সদস্যদের ওপর। কিন্তু র্যাবের এই গোপন খবর কীভাবে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে চলে গেল? কারা এটি ফাঁস করল? এই প্রশ্নের এখনও উত্তর মেলেনি। যে ১৩ জনকে আটক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কেবল সাইদুরের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনতে পেরেছে র্যাব।
এলাকায় গ্রেপ্তার আতঙ্ক: এ ঘটনার পর থেকে বারইয়ারহাট পৌর বাজারসহ আশপাশের এলাকায় পুলিশ ও র্যাবের গাড়ি টহল দিচ্ছে। চলছে গ্রেপ্তার অভিযানও। এতে এলাকার মানুষের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে। বৃহস্পতিবারও বাজারের ঘটনাস্থল এলাকায় ও আশপাশের অনেক দোকান খোলেনি। গতকালও ছিল থমথমে পরিস্থিতি। বারইয়ারহাট পৌর বাজারের সাধারণ সম্পাদক হেদায়েত উল্যা জানান, ঘটনার পর থেকে বাজারের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এলাকা থেকে র্যাব বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে বলে শুনেছেন তিনি।
ঘটনা আছে আরও: গত ১৭ মে ফেনীর পরশুরামে গাড়ি তল্লাশি নিয়ে সাদা পোশাকে থাকা র্যাব-পুলিশের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এর আগে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের ভুজপুর থানার বারমাসিয়া চা বাগান এলাকায় সাদা পোশাকে থাকা র্যাব সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে র্যাবের দুই কর্মকর্তা আহত হন। ভাঙচুর করা হয় গাড়ি। লুট করা হয় অস্ত্র।
- বিষয় :
- চট্টগ্রাম
- র্যাবের ওপর হামলা
- মিরসরাই
- হামলা