ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

হাকালুকি সংলগ্ন এলাকায় বন্যা

রাত হলেই সাপ ও ডাকাত আতঙ্ক

রাত হলেই সাপ ও ডাকাত আতঙ্ক

গোপাল দত্ত, বড়লেখা (মৌলভীবাজার)

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২২ | ১০:০৩ | আপডেট: ২৬ জুন ২০২২ | ১০:০৩

বন্যার পানির বিধ্বংসী স্রোতে ভেসে গেছে ঘরদোর, ভিটার মাটি। যে ঘরগুলো কোনোমতে টিকে আছে, সেগুলোও বসবাসের উপযোগী নয়। দেয়াল ভাঙা, মেঝে স্যাঁতসেঁতে। এ পরিস্থিতিতে আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়া আশ্রয় নেওয়ার তেমন জায়গা নেই মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার অধিকাংশ বানভাসি মানুষের।

উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি হাওর সংলগ্ন মুর্শিবাদকুরা, বড়ময়দান, দুর্গাই, পশ্চিম গগড়া, পূর্ব গগড়া, শ্রীরামপুরসহ বেশিরভাগ গ্রাম পানির নিচে। তালিমপুরের বাংলাবাজার থেকে নৌকায় করে পশ্চিম গগড়া গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে বন্যাকবলিত বাড়িগুলো। গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে দেখা যায়, অনেক বাড়িতে বাঁশ দিয়ে ভিটার মাটি ঢেউয়ের ছোবল থেকে রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। বহু বাড়ি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
পশ্চিম গগড়া গ্রামের আমিনা বেগম। তাঁর বাড়ির ভিটার মাটিও ভেসে গেছে বানের পানিতে। ঘর যেন অনেকটা শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে; ভেঙে পড়ে যেতে পারে যে কোনো সময়। বাড়ির বাসিন্দারা আশ্রয় নিয়েছেন অন্যত্র। দিনে বাড়িতে আসেন আমিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। রাতে আত্মীয়ের বাড়িতে থাকেন। আমিনা বলেন, বন্যার শুরুর দিকে তাঁরা ধান-চাল অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। তিনি ও তাঁর মা রাতে নানাবাড়িতে থাকেন। কারণ, রাতে ঢেউ আর সাপের আতঙ্ক থাকে। আমিনা বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটের কথা জানান। তাঁদের নলকূপ ডুবে গেছে। খুব কষ্ট করে তাঁরা খাবার পানি সংগ্রহ করছেন।
নৌকায় যেতে যেতে কথা হচ্ছিল পশ্চিম গগড়া গ্রামের অনন্ত দাসের সঙ্গে। তিনি পেশায় ভ্যানচালক। অনন্ত বলেন, ১৫ দিন ধরে রোজগার বন্ধ। বাজারে পানি ওঠায় বুক সমান পানিতে তাঁর ভ্যানগাড়িও ডুবে আছে। কথা বলতে বলতে চোখ পড়ল অনন্তের পায়ের দিকে। পায়ে গুটি গুটি দাগ। এগুলো কীসের- জিজ্ঞেস করতেই অনন্ত আক্ষেপের সুরে বলেন, 'আমরার কষ্টের কোনো সীমা নাই। পানিতে দুর্গন্ধ, মাইনষের শরীরে পানিবাহিত নানা ধরনের রোগ দেখা দিছে। আমারও এরকম। ওষুধ কিনতাম টাকা নাই।' শুধু অনন্তই নন, তাঁর মতো আরও অনেকের শরীরে এরকম দাগ দেখা গেছে।
পশ্চিম গগড়ার বাসিন্দা প্রমোধ রঞ্জন দাস। বন্যায় তাঁর বাড়ির উঠানেও পানি ছিল। কিছুটা কমেছে। তবে তাঁর দুর্ভোগ কাটেনি। তিনি বলেন, কষ্ট করে দিনে যেমন-তেমন থাকা যায়, রাত হলে চিন্তা সাপ আর ডাকাতের। বিদ্যুৎ নেই বন্যার শুরু থেকেই। একই গ্রামের সুজিত দাস বলেন, বন্যায় হাওরপারের মানুষ এখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। তাঁদের দিন কোনোমতে কেটে গেলেও রাত কাটে ঢেউ, ডাকাত আর সাপের আতঙ্কে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ নেই। মানুষের রান্নার কষ্ট। শৌচাগারের সুবিধা নেই। বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। টিউবওয়েল পানির নিচে।
হাকালুকি হাওরের পানি বেড়ে যাওয়ায় গত এক সপ্তাহ থেকে বড়লেখার সুজানগর, তালিমপুর, বর্নি ও দাসেরবাজার ইউনিয়নে এ বন্যা দেখা দেয়। গত শনিবার পর্যন্ত এলাকার বন্যা পরিস্থিতি ছিল অপরিবর্তিত। এ তিন ইউনিয়ন ছাড়াও নিজবাহাদুরপুর, উত্তর শাহবাজপুর, দক্ষিণ শাহবাজপুর, বড়লেখা সদর ও দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
বড়লেখা উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপসহকারী প্রকৌশলী মঈন উদ্দিন বলেন, এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রেসহ ১৫টি নলকূপের প্ল্যাটফর্ম উঁচুকরণ হয়েছে। পল্লীবিদ্যুতের ডিজিএম এমাজ উদ্দিন সরদার সমকালকে বলেন, হাকালুকি হাওর এলাকায় লাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। মেরামত চলছে। বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রত্নদীপ বিশ্বাস বলেন, পানিবাহিত রোগের ওষুধের জন্য বরাদ্দ চেয়েছি। বরাদ্দ এলে ওষুধ বিতরণ করা হবে। এ ছাড়া তাঁদের মেডিকেল টিম দুর্গত এলাকায় কাজ করছে বলেও জানান তিনি। বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী বলেন, ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে তিন হাজারের বেশি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

আরও পড়ুন

×