টাঙ্গাইলের ঘটনায় বাস চালক রাজা মিয়ার জবানবন্দি
তরুণীকে ধর্ষণ করতে রদবদল করা হয় চালকও

ফাইল ছবি
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২২ | ২২:৫৫
কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের বাসে ডাকাতি ও দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার তদন্তে নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। পুলিশ হেফাজতে থাকা রাজা মিয়া শুরু থেকে ডাকাতিতে জড়িত থাকলেও ধর্ষণে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে আসছিল। তার দাবি ছিল- বাসের মূল চালক, ড্রাইভার ও সুপারভাইজারকে জিম্মি করার পর শুধুই ডাকাত দলের বাসের চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সে। ওই রাতে কাজের জন্য তাকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল। আদালতে জবানবন্দি ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শেষ পর্যন্ত রাজা স্বীকার করল, সর্বশেষ ব্যক্তি হিসেবে সে তরুণীকে ধর্ষণ করে। ওই সময় ডাকাত সর্দার বাসটি চালাচ্ছিল। তরুণীর সঙ্গে বর্বর আচরণ করতেই ডাকাত চক্রের দুই চালক রদবদল করে ড্রাইভিং সিটে বসে।
রাজা জানায়, জিম্মি করার পরপরই ডাকাত গ্রুপের এক সর্দার বাসটি চালাচ্ছিল। ওই সময় রাজা মিয়াকে যাত্রীদের হাত-পা, মুখ ও চোখ বাঁধার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেটা ঠিকঠাক করতে না পারায় তাকে চালকের আসনে বসিয়ে দেয় সর্দার। সবার কাছ থেকে মালপত্র, টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করার পর পেশায় পোশাক কর্মী ওই তরুণীকে ধর্ষণ করে পাঁচ ডাকাত। তাদের মধ্যে সর্দারও ছিল। এরপর সর্দার চালকের সিটে বসার পর রাজা ধর্ষণ করে ওই তরুণীকে। মালপত্র লুট করার সময় প্রতিবাদ করায় ওই তরুণীকে টার্গেট করা হয়।
গতকাল শনিবার টাঙ্গাইলের আদালতে দেওয়া রাজা মিয়ার ১৬৪ ধারার জবানবন্দি ও গ্রেপ্তার আবদুল আওয়াল ও নুরনবীকে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল আওয়াল ও নুরনবীও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। গ্রেপ্তার ডাকাত দলের তিন সদস্য জানিয়েছে, চলতি বছরের শুরুর দিকে আশুলিয়া ও টাঙ্গাইলে আরও দুটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে আশুলিয়ার ঘটনায় ডাকাত চক্র বাসের এক নারী যাত্রীকে ধর্ষণ করে। তবে ওই নারী ও বাসের মালিকপক্ষ বিষয়টি চেপে যাওয়ায় তা জানাজানি হয়নি। এ ছাড়া টাঙ্গাইলে সিলিন্ডার গ্যাসভর্তি ট্রাক ডাকাতি হয়। দুই ঘটনায় এ ডাকাত চক্র জড়িত ছিল। তদন্ত সংশ্নিষ্টরা বলছেন, টাঙ্গাইলের ঘটনার সূত্র ধরে মহাসড়ক ঘিরে আরও বেশ কয়েকটি ডাকাত গ্রুপের তথ্য সামনে আসছে।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, ডাকাত দলের সদস্যরা টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে ছুরি ও ঘাস কাটার কাঁচি কেনে। এরপর একটি ব্যাগে করে তা নিয়ে যায়। এর আগে টাঙ্গাইলের আরেকটি এলাকা থেকে তারা চাপাতি কিনতে যায়। সেখানে দাম বেশি চাওয়ায় না কিনে ফিরে আসে।
ডাকাতি করতে গিয়ে কেন তরুণীকে ধর্ষণ করেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে রাজা মিয়া পুলিশের কাছে দাবি করে, 'হঠাৎ তার মাথার ওপর শয়তান ভর করেছিল। এই ঘটনা জানতে পারলে তার স্ত্রী আত্মহত্যা করবে। ডাকাতদের বাস চালানোর জন্য ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল। তবে ডাকাতি শেষে টাকা ভাগাভাগির সময় তার ভাগে মাত্র আড়াইশ টাকা পড়ে। এত কম টাকা পাওয়ায় প্রতিবাদ শুরু করে রাজা মিয়া।' এরপর ডাকাত দলের সর্দার তাকে আরও এক হাজার টাকা দেয়। পরবর্তী অপারেশনে রাজা মিয়াকে পুষিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়।
পুলিশের আরেক কর্মকর্তা জানান, বাসটি মির্জাপুরের গোড়াই পর্যন্ত গিয়ে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে ইউটার্ন নিয়ে আবার টাঙ্গাইলের দিকে যাত্রা করে। ওই সময় ডাকাত দলের সদস্যদের মধ্যে লুণ্ঠিত মোবাইল ফোনসেট, স্বর্ণালংকার ও টাকা নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। ডাকাত গ্রুপের এক সদস্য অভিযোগ করে- কোনো এক যাত্রীর কাছ থেকে নেওয়া ২০ হাজার টাকা তাদের দলের একজন লুকিয়ে ফেলেছিল। তখন অন্য ডাকাতরা তার দেহ তল্লাশি শুরু করে। টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে তুমুল হট্টগোলের সময় বাসটি হঠাৎ খাদে পড়ে যায়।
রাজা মিয়া পুলিশকে জানিয়েছে, বাসটি খাদে পড়ার পর ডাকাত সদস্যরা জানালা দিয়ে লাফিয়ে বের হয়ে আসে। শুরুতে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়ক ধরে মধুপুরের দিকে দৌড়াতে থাকে। কিছু দূর যাওয়ার পর একটি বাসকে সংকেত দেয় তারা। প্রথমে তিনজন ওই বাসে ওঠে। কিছু দূর যাওয়ার পর বাকিরা বাসটিতে ওঠে। নিজেদের পরিবহন শ্রমিক হিসেবে পরিচয় দেয়। মধুপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে নামার পর অটোরিকশায় ডাকাত দলের এক সদস্যের নানির বাসায় গিয়ে ওঠে। ওই বাসায় গিয়ে টাকা ও মালপত্র ভাগাভাগি হয়। সবার কাছ থেকে সেখানে মাত্র ৩ হাজার ৪০০ টাকা বের হয়। এ ছাড়া দুটি কানের দুল, চেইন ও মোবাইল ফোনসেট ছিল। লুণ্ঠিত টাকা অনেকে লুকিয়ে ফেলায় ভাগাভাগির সময় টাকার অঙ্ক কম ছিল। ভাগাভাগির পর যে যার মতো চলে যায়। রাজা মিয়া বাড়িতে গিয়ে মোবাইল ফোন অন করেই ঘুমাচ্ছিল।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট আরেক কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তার আবদুল আওয়াল ও নুরনবী নিয়মিত হেরোইন সেবন করে। ১০ জনের এ গ্রুপটির সবাই একে অন্যের পরিচিত নয়। রাজা মাত্র চারজনকে চিনত। বাকি ৬ জন তার অপরিচিত।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার বলেন, রাজা মিয়া ডাকাতি ও ধর্ষণ দুটিতে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। পুরো চক্রটিকে যে দু'জন নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। দ্রুত তাদের আইনেরও আওতায় আনা সম্ভব হবে।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের বাসটি নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়। রাতে যাত্রীবেশে ১০-১২ জন ডাকাত ওই বাসে ওঠে। এরপর তারা তিন ঘণ্টা বাসের ভেতর নারকীয় তাণ্ডব চালায়।
- বিষয় :
- তরুণীকে ধর্ষণ
- বাসে ডাকাতি