কিশোরগঞ্জে টাকা ছাড়া কাজ হয় না

সাইফুল হক মোল্লা দুলু, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০১৯ | ১৩:১১
কিশোরগঞ্জ শহরের চরশোলাকিয়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আলী। নরসুন্দা নদীর
পাড়ে তার ৯ শতাংশ জমি থেকে উন্নয়ন কাজের নামে মাটি কেটে নেয় স্থানীয় সরকার
প্রকৌশল অধিদপ্তর। এতে জমিতে সৃষ্টি হয় বিশাল গর্ত। এ বিষয়ে ২০১৭ সালে
উপজেলা সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (সদর) কার্যালয়ে অভিযোগ করেন তিনি। সে সময় ওই
অফিসে কর্মরত একজন বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি
করেন। পরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে সমাধান চান আব্দুল আলী।
জমির গর্ত ভরাট করে দিতে বলেন। প্রায় বছরখানেক ঘুরেও সমাধান না পেয়ে
হাইকোর্টে মামলা করেন তিনি। হাইকোর্ট জমি ভরাট করে দেওয়ার জন্য স্থানীয়
প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়ে রায় দেন। এরপর তিনি একাধিকবার জেলা প্রশাসকের
কার্যালয়ে রায় বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও
জমির গর্ত ভরাট করে দেওয়া হয়নি।
আব্দুল আলী আরও জানান, এখানেই শেষ নয়। চরশোলাকিয়া এলাকায় তার সাড়ে ১৬ শতাংশ
জমি প্রতিপক্ষ প্রতিবেশী উসমান গংরা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে কিশোরগঞ্জ সদর
উপজেলা ভূমি অফিস থেকে খারিজ করিয়ে নেয়। খবর পেয়ে এসিল্যান্ড (সদর) অফিসে
উসমান গংয়ের বিরুদ্ধে আবেদন করেন তিনি। অফিস থেকে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়,
তারা কিছু করতে পারবে না। পরে তিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বরাবর
আবেদন করেন। কিন্তু অনেক দিন ঘুরেও ফল না পেয়ে বাধ্য হয়ে কিশোরগঞ্জ সাব জজ
আদালতে মামলা দায়ের করেন। ক্ষোভ জানিয়ে আব্দুল আলী বলেন, ভূমি বিরোধ
নিষ্পত্তি করতে কোনো অফিসেই টাকা ছাড়া কাজ করা যায় না। আবার প্রতিপক্ষের
কাছে মোটা অঙ্কের টাকা নিলে অন্যপক্ষের কোনো কাজই করে দেন না সংশ্নিষ্ট
বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার যশোদল গ্রামের আজিজুল ইসলামের স্ত্রী নাজমা আক্তার
জানান, মাত্র তিন শতাংশ জমি খারিজের জন্য তিনি অনলাইনে আবেদন করেন। এরপর
প্রায় তিন মাস যশোদল ভূমি অফিসে ঘুরেও কোনো ফল পাননি। যশোদল ভূমি অফিসের
কর্মকর্তা মো. হুমায়ূন কবির তাকে নানা কথা বলে তিন মাস
ঘোরানোর পর গত ১৬ জুলাই খারিজের কাগজপত্র সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার
(ভূমি) অফিসে পাঠান। ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে তাকে ১৯ জুলাইয়ের পর উপজেলা
ভূমি অফিসে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এরপর ১৯ জুলাই থেকে প্রতিদিন উপজেলা ভূমি
অফিসে যোগাযোগ করেন নাজমা আক্তার। প্রতিদিনই তাকে বলা হয়, 'আজ না, আগামীকাল
আসুন।' এভাবে প্রায় দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ
অবস্থায় ২৯ জুলাই তিনি সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাবেয়া আক্তারের
সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও তার জমি খারিজ হচ্ছে না বলে
জানান। নাজমা বলেন, যশোদল ভূমি অফিসের কর্মকর্তা ও তার লোকজন নাজমার
ভাইদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ নেওয়ায় তার জমিটি আজও খারিজ হয়নি।
শুধু আব্দুল আলী কিংবা নাজমা আক্তারই নন, কিশোরগঞ্জ জেলা শহর ও জেলার ১৩টি
উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কয়েকশ' মানুষ জমি খারিজের আবেদন করার পরও খারিজ ও
নামজারির কাগজ না পেয়ে চরম হতাশায় আছেন। তাদের অভিযোগ, টাকা ছাড়া ভূমি
অফিসে কোনো কাজ হয় না। ভুক্তভোগীরা বলেন, কোনো কোনো এসিল্যান্ড সৎ এবং ভালো
কর্মকর্তা হলেও দালাল চক্রের কারণে ভূমি সংক্রান্ত কাজ স্বচ্ছন্দভাবে করতে
পারছেন না।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন ভূমি অফিস ঘুরে জানা গেছে, ভূমি অফিসগুলো কার্যত
দালাল চক্রের হাতে বন্দি। ভূমি অফিসের একশ্রেণির তহসিলদার ও কর্মচারীর
যোগসাজশে দালালরা জমা-খারিজের সাধারণ আবেদনের জমিকে নিজেদের লোকজনের
মাধ্যমে অংশীদার হিসেবে দাঁড় করিয়ে জটিল করে তোলে। এসিল্যান্ড অফিসে
দরখাস্ত দিয়ে স্বাভাবিক খারিজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পরে দুই পক্ষকে
নিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় ভূমি অফিসের কতিপয়
দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালাল চক্র। এসব কাজে ভূমি অফিসসহ জেলা
প্রশাসনের রাজস্ব শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জড়িত বলে একাধিক সূত্রে
জানা গেছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসের সামনে খারিজ ও নামজারির
জন্য নির্ধারিত ফি দেওয়ার সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত
ফির বাইরে হাজার হাজার টাকা খরচ করেও তারা সঠিক সময়ে খারিজের কাগজ পান না। এ
ছাড়া অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে প্রতিটি টেবিলে বাড়তি টাকা দিতে হয়।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তাদের চাহিদামতো টাকা না দিলে খারিজের নথি হারিয়ে গেছে
কিংবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।
নাম খারিজ করতে আসা একাধিক ব্যক্তি জানান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) সদর অফিসে
কিছুদিন আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযান চালিয়ে ১০ হাজার টাকাসহ এক
কর্মচারীকে গ্রেফতার করে। এ ছাড়া দুদক, টিআইবি ও সনাক যৌথভাবে ভূমি অফিসের
অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে সরাসরি জবাবদিহিমূলক অনুষ্ঠান করেছে। এরপর সদর
উপজেলায় ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করায়
সম্প্রতি তারা সরাসরি টাকা না চেয়ে দালাল চক্রের মাধ্যমে কৌশলে অর্থ
নিচ্ছে। তবে নির্দিষ্ট ফি দিয়েও কিছু কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। কিন্তু জেলার অন্য
১২টি উপজেলার ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্রের কোনো
পরিবর্তন হয়নি।
শহরের নিউটাউন এলাকার শিক্ষক মাহফুজুর রহমান জানান, পৈতৃক জমি খারিজ করতে
তিনি সদর উপজেলা ভূমি অফিসে যান। কয়েকদিন পর তাকে জানানো হয়, কিছু টাকা
দিতে হবে। পরে তিনি কিশোরগঞ্জ সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে খারিজের আবেদন
করেন। সেখান থেকেও তাকে জানানো হয়, খারিজ করতে কিছু টাকা দিতে হবে। তিনি
টাকা না দেওয়ায় ছয় মাস পর তার খারিজ আবেদনটি বাতিল করা হয়। পরে তিনি আপস
করে টাকার বিনিময়ে খারিজটি সম্পন্ন করতে বাধ্য হন।
তাড়াইল উপজেলা সদর ইউনিয়নের দশদ্রোন গ্রামের মো. ইসরাফিল তার জমি খারিজের
জন্য সাত মাস আগে আবেদন করেন। কিন্তু ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা মো. নাসির
উদ্দিন বারবার আজ না কাল বলে সময়ক্ষেপণ করেন। তার অফিসে কিছু টাকা দেওয়া
হলেও কোনো কাজ হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সদর ইউনিয়ন অফিসের ভূমি কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন
বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। তারপরও তিনি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
তাড়াইল উপজেলার ধলা ইউনিয়নের গজেন্দ্রোপুর এলাকার নারায়ণ চন্দ্র জানান,
টাকা খরচ করেও সাত মাস ধরে ঘুরছেন। কিন্তু জমি খারিজ যেন সোনার হরিণ।
এ বিষয়ে ধলা ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা শাহজাহান হোসাইন বলেন, কাগজপত্র
পরীক্ষা-নীরিক্ষা করার পর বিধি মোতাবেক তার আবেদনপত্রটি যথারীতি এসিল্যান্ড
অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কটিয়াদী, তাড়াইল ও হোসেনপুর উপজেলার ভুক্তভোগীরা জানান, জমি খারিজের জন্য
নির্ধারিত ফির বদলে ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও এসিল্যান্ড অফিসের
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। তাছাড়া আরওআর, সিএস ও মাঠ
রেকর্ডের খসড়া তুলতে গেলেও সরকারি ফির বাইরে বাড়তি টাকা দিতে হয়। ভূমি
অফিসের এসব বিষয় ওপেন সিক্রেট হওয়ায় কেউ কোনো কথা বলে না।
কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে,
জমা-খারিজ ও ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে জেলা প্রশাসকের রাজস্ব
শাখায় আপিল করা হয়। প্রতি মাসে ১৩টি উপজেলা থেকে গড়ে ৫০টির মতো আবেদন পাওয়া
যায়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সপ্তাহে দু'দিন শুনানি গ্রহণ করে
ওইসব আপিল মামলা নিষ্পত্তি করেন। মামলা নিষ্পত্তিতে আইনজীবীরা সরাসরি
উপস্থিত হয়ে কাগজপত্র প্রদর্শন করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। কাগজপত্র
সঠিক পাওয়া গেলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সরাসরি এসিল্যান্ডকে সেসব
খারিজ সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেন এবং জটিল সমস্যার
নিষ্পত্তি তিনি নিজেই করেন। তাই প্রতি মাসে দায়েরকৃত অধিকাংশ মামলাই
নিষ্পত্তি হয়ে যায়। জেলা প্রশাসকের রাজস্ব শাখায় উল্লেখযোগ্য
অনিষ্পত্তিযোগ্য মামলা নেই বলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী অরূপ রায় জানান।
কিশোরগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল কাসেম
জানান, পুরো জেলার ভূমি অফিসগুলোকে কেন্দ্র করে দালাল চক্রের শত শত সদস্য
সক্রিয় রয়েছে। তাদের ইশারা-ইঙ্গিত ছাড়া খারিজের কাজ সমাধান হয় না।
দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৎ এবং ভালো হলেও কোনো লাভ নেই। কারণ ওইসব দালাল ও
অফিস কর্মচারীদের ঘুষ না দিলে কাজ হয় না। তিনি আরও বলেন, ইউনিয়ন ভূমি
অফিসের অধিকাংশ কর্মকর্তাই পরোক্ষভাবে দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে।
কিশোরগঞ্জ সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাবেয়া আক্তার বলেন, কয়েকদিন হলো তিনি
এখানে যোগদান করেছেন। আগে কী হয়েছে, তা তার জানা নেই। তিনি আসার পর তার
অফিস দুর্নীতি ও ঘুষমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। কোনো কর্মচারী অনিয়ম-দুর্নীতিতে
জড়িত হলে তিনি তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
জমা-খারিজ ও জমি সংক্রাস্ত কোনো সমস্যা হলে তিনি ভুক্তভোগীদের তার সঙ্গে
সরাসরি যোগাযোগ করতে বলেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দুলাল চন্দ্র সূত্রধর বলেন, তিনি তার অফিসে
প্রতি সপ্তাহে ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির শুনানি গ্রহণ করেন এবং
দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেন। শুধু তাই নয়, ১৩ উপজেলার সহকারী কমিশনারদের
(ভূমি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে- জমি সংক্রান্ত বিষয়ে মানুষ যেন হয়রানির শিকার
না হয়। জমা-খারিজসহ অন্যান্য বিরোধ যেন দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়। তাছাড়া
জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী এখানে যোগদানের পর থেকে মাসিক
প্রতিটি সভায় ভূমি সংক্রান্ত কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কর্মকর্তাদের
সতর্ক করে দেন। এসিল্যান্ডসহ কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো
অভিযোগ পাওয়া গেলে তা খতিয়ে দেখে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জানান।
- বিষয় :
- ভূমিবিরোধ ও দুর্নীতি -৪