ছাত্রাবাসের খাবারে কাটছাঁট
-copy-(1)-samakal-63884ca92fd03.jpg)
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ-সমকাল
সাজ্জাদ রানা, কুষ্টিয়া
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২২ | ০০:৪৫
কুষ্টিয়া সদরের ঝাউদিয়ার সাব্বির হোসেন পড়েন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। কয়েক বছর ধরে থাকছেন শহরের নিশান মোড়ে গ্রিন ছাত্রাবাসে। সকালে উঠে নাস্তা করেন ভাত-ভাজি-ভর্তা দিয়ে। দুপুরে ভাতের সঙ্গে থাকে মাছ, সবজি ও ডাল। রাতে থাকে শুধু সবজি-ডাল। মাঝেমধ্যে দুপুরে ব্রয়লার মুরগির মাংস থাকে খাবারের তালিকায়। এতেই মাসে এখন তাঁর ব্যয় প্রায় তিন হাজার টাকা।
অথচ ছয় মাস আগে এরচেয়ে ভালো খেয়ে খরচ হতো দুই হাজার টাকা। মেসের সিট ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তাঁর মাসে ব্যয় হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকার বেশি। গত ছয় মাসে সাব্বিরের মতো মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের ব্যয় বেড়েছে বহুলাংশে। আগে বাড়ি থেকে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা আনলেও কিছু টাকা থেকে যেত। এখন পাঁচ হাজারেও সামাল দেওয়া কঠিন হচ্ছে বলে জানান সাব্বির।
পিটিআই রোডের আল-আমিন মেসের ছাত্র আরিফুল ইসলামের বাড়ি দৌলতপুরে। সরকারি কলেজের ছাত্র আরিফ চলেন টিউশনি করে। এখন মেসের খরচ চালাতেই নাভিশ্বাস উঠছে তাঁর। দুটি টিউশনি করে যা পান, তা মেসেই শেষ। মাস শেষে হাত খরচের টাকা থাকে না। বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোর সাধ্য নেই পরিবারের। কুষ্টিয়া শহরের একাধিক মেস ও ছাত্রাবাস ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গরিব ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।
সিট ভাড়া, বই-খাতা-কলম ও নিত্যপণ্যসহ সব কিছুর দামের ঊর্ধ্বগতিতে মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের বিপদ বেড়েছে কয়েক গুণ। গত বছরের শেষ দিকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় কুলাতে পারলেও এখন পাঁচ হাজারেও সামাল দিতে পারছেন না। অনেকে বাধ্য হয়ে মেস ছেড়ে বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করছেন।
খাবারের তালিকায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে মেসে। মাংসের পরিবর্তে ছোট মাছ দিয়ে কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছেন। ডিম, সবজি ও ডাল দিয়ে পার হচ্ছে অনেক দিন।
টিনের ছাউনি দেওয়া আধাপাকা গ্রিনহাউস ছাত্রাবাস থাকেন ১৫ শিক্ষার্থী। কয়েকজন লেখাপড়া শেষ করে চাকরি খুঁজছেন। সেখানে কথা হয় পাঁচজনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, করোনা শুরু হলে অন্য মেসে ভাড়া বাড়লেও তাঁদের মালিক বাড়াননি। সিট ভাড়া ৮০০ টাকা দিতে হচ্ছে। তবে খাবার খরচ বেড়েছে। আগে দিনে তিনবেলা খেতে একজনের খরচ হতো প্রায় ৫০ টাকা। এখন বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে। তেল, চাল, ডাল, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, পেপারের পাশাপাশি খালার (বুয়া) বিলও বেড়েছে। সবজি ও ডিমের দাম কিছুটা কমলেও মাংস ও মুরগির দাম বেশি।
তারিক আজিজ ও জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, আগে প্রতি শুক্রবার গরুর মাংস কিনলেও এখন মাসে এক দিন কেনা হয়। ১৫ জনের জন্য কেনেন এক কেজি। সপ্তাহে এক দিন থাকে ব্রয়লার মুরগি। বড় মাছের পরিবর্তে ছোট মাছ কেনেন। আগে দুপুর ও রাতে আমিষ থাকত; এখন শুধু দুপুরে মাছ, ডিম বা মাংস থাকে। দু'বেলা থাকে সবজি।
শিক্ষার্থীরা জানান, রান্নার খালার বেতন আগে জনপ্রতি ২০০ টাকা হলেও এখন বেড়ে হয়েছে ৩০০ টাকা। গ্যাস বিল মাসে তিন হাজার, পানি ৬০০, বিদ্যুৎ বিল তিন হাজার ও খোলা সয়াবিন তেল ২০০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। চার দিনে মেসে সাড়ে চার হাজার টাকার বেশি বাজার লাগে। জাহাঙ্গীর বলেন, মাসে মেস ভাড়া ও খাবারের ব্যয়ের পাশাপাশি চাকরির পরীক্ষা দিতেও খরচ আছে। মেসে থেকে বেকার জীবন কাটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। খরচ কমিয়েও চলা দায়।
এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে হুসাইন রহমান। বাড়ি সদর উপজেলার নৃসিংহপুর। তার ভাষ্য, মেস ভাড়া, খাবার ও হাত খরচের জন্য পাঁচ হাজার টাকার সঙ্গে কোচিং খরচ আলাদা এক হাজার টাকা লাগে।
কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের আশপাশে শতাধিক মেস রয়েছে। দু-একটি বাদে প্রতিটিতে সিট ভাড়া বেড়েছে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। আরাফাত হোসেন ও নাঈম নামে দুই শিক্ষার্থী জানান, সরকারি কলেজের পাশেই একটি মেসে থাকেন তাঁরা। সিট ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা। টিউশনি করে খরচ চালান। বাড়ি থেকে টাকা দেওয়ার সাধ্য নেই।
শোভন হোসেন নামে এক মেস ম্যানেজার বলেন, তিনি পাঁচ বছর ধরে মেসের দায়িত্বে আছেন। দুই থেকে তিন বছর আগেও তিন হাজার টাকায় সারা মাসের খরচ অনায়াসে চলে যেত। এখন পাঁচ হাজারেও মাসে দুই দিন মাংস ও বড় মাছ কেনা যায় না। শিক্ষার্থীদের মেসজীবন কঠিন হয়ে গেছে।
কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক লাল মোহাম্মদ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যাঁরা গরিব পরিবারের, তাঁদের মেসে থেকে লেখাপড়া করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে সরকারের ভাবা উচিত। তা না হলে তাঁদের শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।