ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

ক্রেতাশূন্য মাস্কের দোকান

ক্রেতাশূন্য মাস্কের দোকান

কিশোগঞ্জ শহরের নরসুন্দা সেতুর ওপর মাস্কের দোকানে অলস সময় কাটাচ্ছেন হাফিজ উদ্দিন-সমকাল

মোস্তফা কামাল, কিশোরগঞ্জ

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০

খোলা স্থানে দোকানে থরে থরে মাস্ক সাজিয়ে বসে আছেন হাফিজ উদ্দিন। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই মানুষের কাছে মাস্ক বিক্রি করে জীবিকার ব্যবস্থা করতে এ ব্যবসায় নামেন তিনি। তবে আগের মতো ক্রেতা নেই। মাঝে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমলেও কিছুদিন ধরে ফের ঊর্ধ্বমুখী। তবুও মানুষের মাস্কে আগ্রহ না থাকায় তাঁর দোকানে বিক্রি হচ্ছে কম। কিশোরগঞ্জের হারুয়া এলাকার মৃত আশরাফ আলীর ছেলে হাফিজ উদ্দিনের মাস্ক বিক্রি করে যে আয় হয়, তা দিয়ে খরচ চলে সংসারের।
শহরের সরকারি গুরুদয়াল কলেজের পাশে নরসুন্দার সেতুর ওপর অস্থায়ী দোকানে কথা হয় হাফিজ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, কলেজ খোলা থাকলে ছাত্রীরা বেশি মাস্ক কেনেন। তাঁর ধারণা, মেয়েরা 'ফ্যাশন' হিসেবে মাস্ক কেনেন বেশি। দোকানে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ১২০ টাকার মাস্ক আছে। করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখীর সময়ে দৈনিক ছয় হাজার টাকার মাস্ক বিক্রি হতো। তখন প্রায় ৫০ হাজার টাকার মাস্ক মজুত রাখতেন। বিভিন্ন উপজেলার ব্যবসায়ীরা পাইকারি কিনতেন। ছয় মাস আগেও বিক্রি করেছেন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার। কিন্তু এখন এক হাজার টাকার মতো বিক্রি হয়। পাইকারি বিক্রি বন্ধ। সবসময় হাজার দশেক টাকার মতো মাস্ক মজুত রাখেন তিনি।
হাফিজ উদ্দিনের দোকানে বিক্রি যেমন কমেছে, মানুষের মুখে মাস্কের দেখাও মিলছে কম। হাটবাজার, বাসস্ট্যান্ডসহ জনবহুল স্থানে মানুষ মাস্ক পরছে না বললেই চলে। অথচ সারাবিশ্বে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী; দেশেও করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত রোববারের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত একজন মারা গেছেন। শনাক্ত হয়েছে ছয়জন। চীন, জাপান, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে করোনার নতুন ধরনের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও দেশে এখনও সংক্রমণের হার ১ শতাংশের নিচে।
সোমবার সকালে কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা নয়ন ও সোহাগ প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে রোগী ও স্বজনদের কাছে পাঁচ টাকায় একবার ব্যবহারযোগ্য মাস্ক বিক্রি করছেন। তাঁরা হাসপাতাল ছাড়াও অফিস ও বিভিন্ন বাজারে মাস্ক বিক্রি করেন। নয়ন ও সোহাগ জানান, করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের সময় দিনে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার মাস্ক বিক্রি হতো। এখন দৈনিক বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকার।
ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, মাস্কের বিক্রি দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে। স্টেশন রোডের বিজন মেডিকেল হলের মালিক বিজন কুমার সরকার ওষুধের পাশাপাশি মাস্কও বিক্রি করেন। তিনি জানান, আগে দোকানে অন্তত দুই হাজার টাকার মাস্ক মজুত রাখতেন। দৈনিক বিক্রি হতো ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার। এখন বিক্রি হয় দৈনিক ১০০ থেকে ২০০ টাকার। তাঁর দোকানে ৫ থেকে ৩০ টাকা দামের মাস্ক রয়েছে।
কিশোরগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন এক শিক্ষককে একটি খেলার অনুষ্ঠানে মাস্কবিহীন দেখা যায়। মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখন করোনা ছিল তখন মাস্ক ছাড়া এক দিনও বের হননি। এখন করোনা নেই বললেই চলে। সে কারণে মাস্ক পরছেন না। সংক্রমণ শুরু হলে পরবেন।
জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি একেএম ফারুকও মাস্কবিহীন ছিলেন। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণের সময় মাস্ক পরেছেন। এখন কিশোরগঞ্জে করোনা নেই, তাই ঝুঁকিও নেই। সবসময় মাস্ক পরলে অস্বস্তি লাগে। তবে সংক্রমণ দেখা দিলে আবার পরবেন।
জেলার সবচেয়ে বড় পাইকারি সবজির হাট বড়বাজার। সেখানে সকালে বিভিন্ন উপজেলাসহ অন্য জেলা থেকেও প্রচুর শাকসবজি ও মসলাজাতীয় পণ্য আসে। সোমবার সকালে সেখানে গিয়ে শত শত ক্রেতা-বিক্রেতা দেখা গেলেও কারও মুখে মাস্ক ছিল না। প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তাড়াইলের সিন্ধাকরাতি গ্রামের সবজিচাষি আসাদ মিয়া ৭০০ পিস ফুলকপি নিয়ে বাজারে এসেছেন।
তাঁর মুখেও মাস্ক ছিল না।
আসাদ মিয়া বলেন, এখন তো করোনা নেই। সে কারণে কেউ মাস্ক পরে না, তিনিও পরেননি। তবে ধুলোবালি থেকে রক্ষাসহ মাস্ক পরার অনেক উপকারিতার কথা তিনি শুনেছেন। সে কারণে মাস্ক পরা উচিত বলে মত তাঁর।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কিশোরগঞ্জে গত রোববার পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ২৭৩টি। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৪৮৩ জনের করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। মারা গেছেন ২১৫ জন। জেলায় ২০২০ সালের ৫ এপ্রিল করিমগঞ্জে একজন রোগী মারা যান। সর্বশেষ গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ভৈরবে একজন মারা গিয়েছিলেন। এর পর থেকে কিশোরগঞ্জ মৃত্যুশূন্য। গত বছরের ১৫ আগস্ট জেলায় সর্বোচ্চ ৩ হাজার ২৮৪ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন।
সংশ্নিষ্টরা জানান, জেলার মোট জনসংখ্যা ৩৩ লাখ ৪৪ হাজার ১৬২ জন। এর মধ্যে টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৯০ শতাংশ, দুই ডোজ নিয়েছেন ৭৪ শতাংশ। ৫৫ শতাংশ মানুষ বুস্টার ডোজ নিয়েছেন। গত ২০ ডিসেম্বর থেকে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে নাগরিক ও সম্মুখযোদ্ধাদের চতুর্থ ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। রোববার পর্যন্ত চতুর্থ ডোজ টিকা নিয়েছেন ২৪৫ জন।
সিভিল সার্জন সাইফুল ইসলাম বলেন, দেশে সংক্রমণের হার একের নিচে হলেও চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় 'বিএফ-৭' নামে ওমিক্রনের নতুন একটি উপধরনের ব্যাপক সংক্রমণ শুরু হয়েছে। ভারতেও শনাক্ত হয়েছে কয়েকজন। এর সংক্রমণ ক্ষমতা ওমিক্রনের চেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে টিকা নেওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তবে কেবল টিকার ওপর ভরসা করলে হবে না। অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে, নিরাপদ দূরত্ব মেনে চলতে হবে। কিন্তু এখন মানুষকে মাস্ক পরতে তেমন আগ্রহী দেখা যাচ্ছে না।
জেলার কভিড হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রথম ঢেউয়ের সময়ই হাসপাতালের ৫০০ শয্যার মধ্যে ২৫০টি কভিড রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল।
১০টি ছিল আইসিইউ, আর ১৫টি ছিল এইচডিইউ শয্যা। এখন আইসিইউ ও এইচডিইউ শয্যা
রেখে বাকিগুলো সাধারণ রোগীদের দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালের কভিডকালীন পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, করোনা চিকিৎসার জন্য এ হাসপাতালের বেশ সুনাম ও সাফল্য ছিল। রাজধানীসহ আশপাশের জেলা থেকেও অনেক কভিড রোগী পাঠানো হতো। এখন কিশোরগঞ্জ জেলা করোনামুক্ত। প্রতিদিনই একই অঙ্কের নমুনা পরীক্ষা হয়। সব নেগেটিভ হয় বলে সিভিল সার্জনের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

×