ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

এক মামলাতেই ৫৭ বছর চট্টগ্রামে!

এক মামলাতেই ৫৭ বছর চট্টগ্রামে!

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০১৯ | ১৩:১১

'কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি'- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত এ কবিতার মতোই অপেক্ষা যেন ফুরাচ্ছে না মুক্তিযোদ্ধা আজমল হোসেনের। ভিটেবাড়ির জমি নিয়ে দায়ের করা একটা মামলার রায় পেতে তিনি অপেক্ষা করছেন ৫৭ বছর। শুধু আজমল হোসেন নন; ভূমি সংক্রান্ত মামলার পেছনে এভাবে যুগের পর যুগ ঘুরছে লাখো মানুষ। প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদালতে এখন ভূমি বিরোধসহ নানানম্ন ইস্যুতে ফৌজদারি মামলা আছে এক লাখেরও বেশি।

আজমল হোসেনের বাবা আবদুস ছমদ। চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায় বসবাস। ভিটেবাড়ি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধের জের ধরে ১৯৬১ সালে একটি মামলা করেছিলেন আবদুস ছমদ। ৩০ বছর মামলা চালিয়ে তিনি মারা যান ১৯৯২ সালে। এর পর উত্তরাধিকারসূত্রে ভূমি সংক্রান্ত এ মামলাটির বাদী হন বড় ছেলে আজমল। তিনি বাদী হওয়ার পর মামলা চালাচ্ছেন ২৭ বছর ধরে। এরই মধ্যে মারা গেছেন এ মামলার চার আইনজীবী- সালেহ আহমদ, আনোয়ারুল কবির চৌধুরী, বজল আহমদ ও মোজাফফর আহমদ। ঢাকা ও চট্টগ্রামে আইনজীবীর ফি, বিভিন্ন নথির সই, মুহুরি, নকল সংগ্রহ, যাতায়াত, খাবার ও আনুষঙ্গিক খাতে এ মামলার পেছনে বাপ-বেটার খরচ হয়ে গেছে ৫০ লাখ টাকার বেশি। তারপরও রায় হচ্ছে না মামলার। জীবদ্দশায় মামলার রায় দেখে যেতে পারবেন কি-না, তা নিয়ে এখন শঙ্কায় আছেন আজমল হোসেন ও তার পাঁচ ভাই-বোন।

মামলার বর্তমান বাদী আজমল হোসেন বলেন, 'দুই যুগেরও বেশি সময় মামলা চলার পরও রায় দেখে যেতে পারেননি বাবা। আমিও এখন জীবনের শেষপ্রান্তে। ১৯৮৭ সালে চাকরি থেকে অবসরে যাই। ৯২ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে এখন উত্তরাধিকারী হিসেবে মামলা চালাচ্ছি আমি। আমরা ছয় ভাই-বোন। জীবদ্দশায় অন্তত এ মামলার রায়টা দেখে যেতে চাই। আদালতের যে রায়ই হোক, আমরা মাথা পেতে নেব।' আইনজীবী হিসেবে ৩৩ বছর ধরে এ মামলা পরিচালনা করছেন দিদারুল আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, 'মূল মামলাটি এখন প্রথম যুগ্ম জজ আদালতে আছে। এরই মধ্যে অন্তত ১০০ বার আমি এ মামলার জন্য আদালতে দাঁড়িয়েছি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক ডজনেরও বেশি বার এ মামলার কার্যক্রম স্থগিত কিংবা পাল্টা স্থগিত হয়েছে। এরই মধ্যে মারা গেছেন এ মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা একাধিক আইনজীবী। মামলাটির রায় দেখার অপেক্ষায় আছি আমিও।'

জানা গেছে, আবদুস ছমদ ছিলেন পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের কর্মকর্তা। ১৯৬১ সালে তিনি চকবাজার এলাকা থেকে একটি জায়গা কেনেন প্রতিবেশী এক ব্যক্তির কাছ থেকে। কিছুদিনের মধ্যে ওই জায়গা নিয়ে চট্টগ্রাম প্রথম সাবজজ আদালতে একটি গোলাভাগের মামলা (বণ্টন মামলা) করেন অপর এক ব্যক্তি। তখন ছোট ছিলেন আজমল হোসেন। এখন সেই আজমল হোসেন জীবনের শেষ প্রান্তে। তবুও নিষ্পত্তি হয়নি মামলা।

মামলার আইনজীবী জানান, ১৯৭১ সালের আগে মামলাটি দায়ের হয়েছিল। ১০ বছর চলার পর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আদালত ভবনে অনেক দলিলপত্র নষ্ট হয়ে যায়। এর পর নানা কষ্টে কিছু নথি সংগ্রহ করে বাদীপক্ষ। স্বাধীনতার পর পুনরায় চালু হয় মামলা। পুরনো হওয়ায় এ মামলার অনেক নথি পাওয়া যাচ্ছে না। আবার মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকে মৃত্যুবরণ করাতেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে গতি। মামলা চলাকালীন বিরোধপূর্ণ জায়গা দখল-বেদখলের ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। এসব নিয়ে স্থগিত-পাল্টা স্থগিতের রায়ও এসেছে অনেকবার। নিম্ন আদালতে কেউ রায় পেলে আরেক পক্ষ উচ্চ আদালতে গিয়ে তা স্থগিত করে আনছে। সেখানে আবার স্থগিতের ওপর কেউ নিয়ে আসছে পাল্টা স্থগিতাদেশ। এভাবে আইনি মারপ্যাঁচ তৈরি হওয়ায় এত দীর্ঘ সময়ের ফাঁদে পড়েছে এ মামলা। দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চলতে থাকায় বাড়তি কিছু ঝামেলাও তৈরি হচ্ছে। শুধু আজমল হোসেনের মামলা নয়; যুগের পর যুগ এভাবে অমীমাংসিত আছে ভূমি সংক্রান্ত অনেক মামলা।

জানা গেছে, মামলার শুনানিতে উপস্থিত হতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন আজমল হোসেন। অনেক দিন ক্রাচে ভর দিয়ে মামলা চালাতে হয়েছে তাকে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। আবার ৫৭ বছরেরও বেশি সময় মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আইনজীবী এবং বিভিন্ন নথি উত্তোলনের ফি বাবদ বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে বাদীপক্ষকে। বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে আসামিপক্ষেরও। উভয় পক্ষের খরচ করা এমন অর্থের পরিমাণ ৫০ লাখ টাকারও বেশি হবে। অথচ বিরোধপূর্ণ ৪০ শতাংশ জায়গা নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত এলে এত দীর্ঘ সময় ভোগান্তি পোহাতে হতো না কোনো পক্ষকেই।

মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে গত দেড় দশকে আদালতের সংখ্যাও তিন গুণ করেছে সরকার। তার পরও চট্টগ্রামে ভূমি সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না দ্রুত। জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধ ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া, দেওয়ানি আদালত থাকলেও তার এক-চতুর্থাংশে বিচারক না থাকা, দেওয়ানি আদালতে ফৌজদারি মামলার কার্যক্রম চলা, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা, বাদী-বিবাদীর মৃত্যু এবং আদালতে আসতে সাক্ষীদের অনীহাও মামলা দীর্ঘসূত্রতায় পড়ার কারণ বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন বলেন, "সাধারণ মানুষের হয়রানি কমাতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে চট্টগ্রাম জেলার ১ হাজার ৬৪ মৌজার ৪০ লাখ খতিয়ান সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চার বছর আগে উদ্বোধন করা হয়েছে 'ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ, রেকর্ড প্রণয়ন ও সংরক্ষণ' কার্যক্রম।" এত উদ্যোগের পরও চট্টগ্রামের দেওয়ানি আদালতে ক্রমশ বাড়ছে মামলার সংখ্যা। দেওয়ানি আদালতে যে এক লাখ মামলা রয়েছে, তার বেশিরভাগই জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধের। এ ছাড়া দলিল বাতিল ও সংশোধন, চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা, বাটোয়ারা, দখল পুনরুদ্ধার, ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ, অর্পিত সম্পত্তি পুনরুদ্ধার, ভূমি জরিপসহ পারিবারিক মামলাও রয়েছে দেওয়ানি আদালতে।

আরও পড়ুন

×