ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

শীতে শ্রমজীবীরা কর্মহীন

শীতে শ্রমজীবীরা কর্মহীন

তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার মধ্যে জীবিকার প্রয়োজনে ঘর থেকে বেরিয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। বরিশাল থেকে শনিবার সকালে তোলা - সমকাল

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ২২:০০

বাগেরহাটের আব্দুল হাকিম তিন বছর ধরে ঢাকায় রিকশায় প্যাডেল মেরে সচল রেখেছেন সংসারের চাকা। তবে শীতে ঘুরছে না তাঁর রিকশার চাকা। ফলে কমে গেছে জীবিকাও। তিনি বলেন, সকাল ও রাতে রিকশা চালানো যায় না। হাত-পা ঠান্ডায় অবশ হয়ে আসে। ফলে শুধু দুপুরে রিকশা চালাতে হয়। আগের মতো রাস্তায় যাত্রীও তেমন নেই। এতে কমে গেছে আয়, দু'বেলা আহার তুলতে হিমশিম খাচ্ছি। গরম কাপড়ে শীত থেকে বাঁচলেও ক্ষুধার কষ্টে ভুগতে হচ্ছে।

একই অবস্থা কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় আসা রিকশাচালক মহিউদ্দিনের। তিনি বলেন, 'সকালে গাড়ি নিয়া বাইর হইছি, পরে আর টিকতে না পাইরা ১১টা বাজে বাসায় চইলে গেছি। এত শীতের ভিতরে রিকশা চালানি যায় না। গ্রামের মতো শীত পড়ছে ঢাকায়। এই শীতে বেশি চালাইতে পারি না।'

কংক্রিটের নগরীতে যখন শীতে শ্রমজীবী মানুষের এ অবস্থা- তখন ঢাকার বাইরের অবস্থা আরও বেদনার। সমকাল প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে উঠে এসেছে শীতে রুটি-রুজি বন্ধ হয়ে যাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্টগাথা।

যশোরের চাঁচড়া মৎস্যপলিল্গর ভাতুড়িয়ার বাসিন্দা সিরাজ শেখ বাড়ির উঠানে বসে জাল বুনছিলেন। আর অদূরেই টুলে বসে ছেলের হাতের কাজ দেখছিলেন তাঁর বৃদ্ধ মা জয়নব বেগম। পাশে গিয়ে আলাপ করতেই সিরাজ শেখ বললেন, 'ঠান্ডায় ডাঙ্গাতেই টিকতি পারছিনে; পানিতি নামবো কিরাম করে!

তাই বসে না থেকে জাল সিলাই করে সময় পার করছি।'

আলাপচারিতা জমে ওঠার পর তিনি জানালেন, বিভিন্ন মৎস্যঘেরে জাল টেনে পাওয়া তাঁর উপার্জনে চলে ৬ সদস্যের সংসার। খাওয়া-পড়া ছাড়াও তাঁর বৃদ্ধ মায়ের প্রতিদিন ওষুধ লাগে ১১০ টাকার। প্রচণ্ড শীতে কয়েক দিন ধরে কাজ বন্ধ।

চাঁচড়া বর্মণ পাড়ার ইন্দ্রজিৎ বর্মণ বললেন, একদিকে মানুষ ঠান্ডায় ভুগছে, তেমনি কর্মহীন হয়ে প্রায় অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।

কুড়িগ্রামের রৌমারীর বন্দবেড় ইউনিয়নের দক্ষিণ বন্দবেড় গ্রামের দিনমজুর আজিবর রহমান (৫৫)। শীতের প্রকোপে তিন দিন ধরে কাজে যেতে পারছেন না। একদিকে সুদ ও এনজিওর ঋণের টাকার চাপ, অন্যদিকে প্রচ শীতে কাজে যেতে পারছেন না। তিন দিন আগে কাজে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে পাওয়া মজুরির টাকা দিয়ে চাল ও শাকসবজি কিনেছেন। শনিবার সকালে কাজে যেতে না পেরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি। আজিবর বলেন, প্রচ শীতে কাজে যেতে পারছি না। কেউ ধারদেনাও দিতে চান না। অনেক কষ্টে আছি।

আজিবরের মেয়ে শিউলী খাতুন জানান, অভাবি সংসারে বাবাই একমাত্র উপার্জনকারী। শীতে কাজে যেতে না পারায় খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।

উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের যাদুরচর চাক্তাবাড়ি এলাকার আব্দুল হাই (৫২) গ্রামে গ্রামে ফেরি করে মালামাল বিক্রি করেন। আয় হয় দিনে ২০০-৩০০ টাকা। তা দিয়ে কোনোমতে চলে ৫ সদস্যের সংসার। গতকাল শীত ও কনকনে ঠান্ডায় বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি। রাতের খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে পরিবারটি। আব্দুল হাই বলেন, 'দুই ছেলের লেখাপড়ার খরচ ও ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চলতে হচ্ছে। শীতে ঘর থেকে বের হওয়া যায় না। আয়-রোজগার বন্ধ। গরম কাপড় কেনার কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না।'

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ৭০ বছর বয়সী হাবিবুর অপার হয়ে বসে আছেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জীবনযুদ্ধে থাকা হাবিবুর রহমানের দুশ্চিন্তা এখন শীতের তীব্রতা নিয়ে। কয়েক দিনের ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীতে ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। গ্রামের বাজারে ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন তিনি। শীত আসায় কাজে যেতে পারছেন না। অনেকটা অনাহারে দিন কাটে তাঁর। ভলাকুট ইউনিয়নের বাজারে দেখা হয় এক জুতার কারিগরের সঙ্গে (মুচি)। তিনি বলেন, 'সকাল থেকে বসে আছি। সারাদিনে ২০ টাকার কাজ করতে পারছি। আগে সারাদিন কাজ কইরা পাইতাম ৪০০-৫০০ টাকা। শীত আওনের পর এখন কাম-কাজ একবারে কইম্যা গেছে। বাজারে গিয়া কী কিনুম ভগবানেই জানে।'

কথা হয় ভলাকুট ইউনিয়নের অপর বাসিন্দা মনিকা আক্তারের সঙ্গে। তিনি কষ্টের কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, 'স্বামী নাই, এক পোলার ঠেং ভাঙা, আরেক পোলার কিডনি রোগ, আরেকটার মাথাত সমস্যা। থাকি অন্যের ঘরে। আগে ফেরি কইরা সংসার চালাইতাম। শীতের কারণে ফেরি করতাম পারি না। মানুষে কাজও দেয় না, কত চেষ্টা করতাছি কাজও পাইতাছি না, এহন কী করমু, ঘরে চাউল নাই, দুই দিন ধইরা চুলাত আগুন নাই। গরিবের কষ্ট কেউ বুঝেনাও মিয়া সাব।'

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের রহিমাপুর গ্রামের মনোয়ার হোসেন, কুষ্টিয়ার কুমারখালীর নাভদিয়া গ্রামের হাদি, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের চৌধুরী ঘুঘাট গ্রামের রাজু আহমেদ জানান, তাঁরা কেউ তিন দিন আগে, কেউ এক সপ্তাহ আগে, আবার কেউ ১৫ দিন আগে পরিবারের সদস্যদের খাবার জোটাতে কাজের সন্ধানে গোয়ালন্দে এসেছেন। কেউ কেউ দু'চার দিন বিভিন্ন গৃহস্থের বাড়িতে কৃষি শ্রমিকের কাজ শেষ করে আবার নতুন কাজের খোঁজে অপেক্ষা করছেন। তবে কাজ জোটেনি।

দৌলতদিয়া ঘাট এলাকার হকার বাচ্চু শেখ জানান, শীতের কারণে মানুষজন কম। তাই তাদের বেচাবিক্রিও নেই বললেই চলে।

জয়পুরহাটের কালাই শহরে অটোভ্যানচালক জহুরুল ইসলাম বলেন, হাঁড়কাপানো শীতে সবাই ঘরে রয়েছে। আর আমাকে পেটের দায়ে ভ্যান নিয়ে রাস্তায় বের হতে হয়েছে। ভ্যান চালিয়ে সারাদিনে যেটুকু পাই, তা দিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্নিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা]

আরও পড়ুন

×