শতবর্ষী পুকুরটি রক্ষায় এগিয়ে এলো না কেউ!

চট্টগ্রামের পাঠানিয়া গোদা এলাকায় প্রায় ভরাট করে ফেলা হয়েছে শতবর্ষী এই পুকুরটি- সমকাল
আহমেদ কুতুব, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০১৯ | ১৫:০৩ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৯ | ১৫:৩৪
পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশ-জরিমানা, হাইকোর্টে রিট করেও চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও পাঠানিয়া গোদা এলাকায় ঠেকানো গেল না শতবর্ষী পুকুরের 'অপমৃত্যু'। ২১ শতক জায়গা জুড়ে থাকা বিশাল পুকুরটি ছিল এলাকার আশীর্বাদ। আশপাশে কোথাও আগুন লাগলে পুকুরটির পানি বাঁচিয়ে দিত সকলকে। এলাকার মানুষ বছরের পর বছর ধরে ব্যবহার করে আসছিল পুকুরটির পানি। পুকুরের পাশে থাকা বায়তুন নূর জামে মসজিদের মুসল্লিরাও নির্ভর করত ওই পুকুরের পানির ওপর। তবে বিশাল এই পুকুরটি ভরাট হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠানিয়া গোদা এলাকায় ধ্বংস হয়ে গেল একমাত্র জলাধারটিও। ভরাট পুকুরের বুকে এখন তৈরি হচ্ছে ইট-পাথরের খাঁচা। চলছে দোকানের প্লট তৈরি, দালানকোঠা ও নানা স্থাপনা নির্মাণের কর্মযজ্ঞ।
শতবর্ষী পুকুরটি বাঁচাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতা চাইলেও এটি রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ তুলেছে একটি মানবাধিকার ও পরিবেশ সংগঠন।
মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহ্সান সমকালকে বলেন, 'চট্টগ্রাম শহরে জলাধার সংকটের কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানির নিচে ডুবে যাচ্ছে নগরী। পানি সংকটের কারণে শহরের কোথাও আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসকে। পানির অভাবে আগুনে ছাই হয়ে যাচ্ছে বহু সম্পদ। পাঠানিয়া গোদা এলাকার শতবর্ষী পুকুরটি রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর, ডিসি, চসিক, চউক ও ফায়ার সার্ভিসকে চিঠি ও নোটিশ দিলেও তারা কেউ এগিয়ে আসেনি। পরে হাইকোর্টে রিট করার পরও জেলা প্রশাসন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পুকুরটি পুনঃউদ্ধারে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।'
পুকুর ভরাটকারী সরোওয়ার উদ্দিন বলেন, 'প্রয়োজন ছিল না বলে বাপ-দাদারা পুকুরের জায়গাটি কাজে লাগাননি। এখন আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে। তাই পুকুরের কিছু অংশ ভরাট করেছি। সেখানে দোকান নির্মাণের জন্য কাজও করছি। পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করলে সেই টাকা পরিশোধ করেই এখন কাজ করছি।'
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, 'একটি সংগঠন ও স্থানীয়দের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে পুকুর ভরাটের সত্যতা পাওয়া যায়। এরপর ভরাটকারীদের নোটিশ করে দুই লাখ ১৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ভরাট করা পুকুরের ওয়াল অপসারণের জন্য নির্দেশও দেওয়া হয়। পুকুরটি রক্ষা করতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।'
পাঠানিয়া গোদার স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইব্রাহিম বলেন, 'শতবছর ধরে এই পুকুরটি বিপদ-আপদে আমাদের রক্ষা করেছে। এখন চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেখে বুক ফেটে যাচ্ছে। তাই ডিসি, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বহু জায়গায় পুকুরটি রক্ষায় চিঠি দিয়েছি আমরা।'
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডের পাঠানিয়া গোদা রোডের বাইতুন নূর জামে মসজিদের পাশেই ২১ শতক জায়গা জুড়ে রয়েছে শতবর্ষী এ পুকুরটি। সরোয়ার উদ্দিন, আবদুল হামিদ, আহসান উল্লাহ গং এই পুকুর ও জায়গার মালিক। তারা দীর্ঘদিন ধরে পুকুরটি দেখভাল করে আসছেন। কিন্তু গত এক বছর ধরে তারা ধীরে ধীরে পুকুরটি ভরাট করতে শুরু করেন। প্রথম দিকে একটু একটু করে ভরাট করলেও, সম্প্রতি মাটি ও বালু ফেলে পুরো পুকুরটি ভরাট করতে শুরু করেন। স্থানীয়রা এর প্রতিবাদ করে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে অভিযোগ করতে থাকেন। ২ দশমিক ৮ শতকের পুকুর ভরাট করায় সরওয়ার উদ্দিন, মো. হাসান ও আবদুল হামিদকে নোটিশ করেন পরিবেশ অধিদপ্তর। গত ৬ মার্চ শুনানি শেষে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক পুকুর ভরাটকারীদের দুই লাখ ১৯ হাজার ৭৭৪ টাকা জরিমানা করে। অভিযুক্তরা জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন। গত ৯ সেপ্টেম্বর পুকুরটি পরিদর্শনে গেলে দেখা যায়, সেই স্থানটি ভরাট করে ইট দিয়ে নির্মিত বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। পরে নোটিশ দিয়ে কাজ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলেও সেটি মানেনি পুকুর ভরাটকারীরা।
পাঠানিয়া গোদার স্থানীয় মানুষ পুকুর ভরাট বন্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের কাছে লিখিত আবেদন করেন। সংগঠনটির চেয়ারপারসন এলিনা খান এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব, সিটি করপোরেশনের মেয়র, চউক চেয়ারম্যান এবং জেলা প্রশাসকের কাছে নোটিশ পাঠান। কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় জনস্বার্থে গত ২৪ মার্চ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ এবং বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চে রিট পিটিশন দায়ের করেন। শুনানি শেষে হাইকোর্ট বিবাদীদের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন। হাইকোর্ট চট্টগ্রামের ডিসিকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেন। তার পরও পুকুর ভরাটকারীরা তাদের কাজ বন্ধ করেনি।
গত মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ২১ শতক আয়তনের পুকুরটি অংশীদাররা ভরাট করে সেখানে দোকানপাট, রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ কাজ অব্যাহত রেখেছে। শতবর্ষী পুকুরটির পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে দোকানের প্লট তৈরি করছে শ্রমিকরা। সেখানে ইট দিয়ে দুটি দোকান তৈরির কাজও চলছে। ভরাট করা অংশের চারদিকে বাউন্ডারি ওয়াল তৈরির কাজ হয়েছে। পূর্বদিকে ভরাট করা মাটি ও বালু সমান করতে দেখা যায় শ্রমিকদের।
- বিষয় :
- পরিবেশ অধিদপ্তর
- পুকুর
- চট্টগ্রাম