ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

টুঙ্গিপাড়ার অনাবাদি জমিতে সোনালি ফসলের ঢেউ

টুঙ্গিপাড়ার অনাবাদি জমিতে সোনালি ফসলের ঢেউ

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত কম্বাইন্ড হারভেস্টার যন্ত্রের সাহায্যে কাটা হচ্ছে ধান-সমকাল

জাহিদুর রহমান, টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ) থেকে

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৩ | ২২:০৩

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার পূর্ব দিকের বিলের বিস্তীর্ণ এলাকা বছরজুড়েই থাকে পানির নিচে। ৩৫ বছর ধরে কচুরিপানা আর ঘাস-পাতায় ছেয়ে থাকা বিলের অনাবাদি জমিতে এখন সোনালি ফসলের ঢেউ। এই বদলে যাওয়ার গল্পটা শুরু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। এই বিলেই তাঁর পৈতৃক জমি রয়েছে ২২ বিঘা। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় নিজেরসহ বিলের ১০০ বিঘা জমিতে আবাদ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে গ্রামে যেতেই ঐতিহাসিক টুঙ্গিপাড়ার রামচন্দ্রপুর পৌঁছতেই চারদিকে সোনালি ধান। ‘ফলন্ত ধানের গন্ধে–রঙে তার–স্বাদে তার ভ’রে যাবে আমাদের সকলের দেহ’– জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘অবসরের গান’ কবিতায় যে ছবি এঁকেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বিলগুলো এখন যেন ঠিক তাই। পাকা ধানের সোনালি রং আর পাকা ফসলের গন্ধে ভরে উঠেছে এখানকার জনপদ। টুঙ্গিপাড়ার কুশলী ইউনিয়নে ফসলের খেতে কম্বাইন্ড হারভেস্টারের মাধ্যমে ধান কাটা উৎসব গতকাল শনিবার উদ্বোধন করেন কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার। এর আগে তিনি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গোপালগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ে ব্রি উদ্ভাবিত কম্বাইন্ড হারভেস্টার যন্ত্রের সাহায্যে ধান কাটা পর্যবেক্ষণ করেন।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এত দিনের পরিত্যক্ত বিলের বুক এখন সোনালি ফসলে ছেয়ে গেছে। বিস্তীর্ণ এলাকা হয়ে উঠেছে শস্যের মায়াবী জগৎ। এখন সেই ফসল গোলায় তোলার আয়োজন।

কৃষিবিপ্লবের এ ছবি টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়ার আরও অনেক গ্রামের। সরকারের নেওয়া ‘সমলয়’ চাষাবাদ প্রকল্পের আওতায় পরীক্ষামূলক শুরু হয়েছে এমন আবাদ। প্রকল্পের আওতায় এক বা একাধিক মানুষের আবাদি-অনাবাদি জমিকে নিয়ে সেটিকে আবাদযোগ্য করে তুলছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এখন পুরো ফসল কেটে দেওয়া হচ্ছে জমির মালিককে। এ জন্য জমির মালিককে খরচ করতে হয়নি এক টাকাও। এ রকম চাষাবাদে সুফল পেলে সাধারণ মানুষও আগ্রহী হয়ে উঠবে, কেউ জমি ফেলে রাখবে না– এটিই ‘সমলয়’ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য।

কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের কথা মাথায় রেখে খাদ্যের জোগান বাড়াতে দেশের এক ইঞ্চি জমি যাতে অনাবাদি না থাকে সেজন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই আহ্বানে এবং তাঁরই নির্দেশে পতিত জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি ও উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ করা হচ্ছে।

টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় এবার ৪৮ জন কৃষকের ১৫০ বিঘা যৌথ জমিতে ‘সমলয়’ পদ্ধতিতে বোরো ধানের চাষাবাদ হয়। চাষাবাদের শুরুতে ট্রেতে বীজতলা করা হয়েছে। যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিক চাষাবাদের এই পদ্ধতিতে কম খরচে কৃষক অধিক ধান উৎপাদন করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা। তাঁরা জানান, এই পদ্ধতির চাষাবাদে কৃষকের বিঘাপ্রতি অন্তত ১২ হাজার টাকা সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া বিঘাপ্রতি হাইব্রিডে ৩৫ মণ ধান উৎপাদিত হবে। উফশী জাতে ২৫ মণের স্থলে ৩০ মণ ধান উৎপাদিত হবে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. শাজাহান কবীর বলেন, আধুনিক চাষাবাদ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ‘সমলয়’ নামের এই পদ্ধতিতে বীজতলা থেকে শুরু করে ধান মাড়াই পর্যন্ত সবই করা হবে আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে। স্বল্প মানুষের শ্রমে যন্ত্রের মাধ্যমে এই চাষের জমিতে কোনো আইল থাকে না। ফলে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের জমিতে বীজতলা থেকে ফসল কাটা সবই একই সময়ে একই সঙ্গে করা হয়।

রামচন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক ও প্রধানমন্ত্রীর ২২ বিঘা জমির তত্ত্বাবধানকারী মহিব শেখ বলেন, নতুন পদ্ধতির চাষাবাদে সবই যন্ত্রের ব্যবহার। এখানে শ্রমিক তেমন লাগে না। ধান কাটার সময় শ্রমিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। তখন শ্রমিককে এক হাজার টাকা মজুরি দিতে হয়। ধান নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। এই চাষাবাদে অধিক ফলন পেয়ে দ্রুত ধান ঘরে তুলতে পারছি। এতে আমাদের অধিক লাভ হবে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ (এসএফএমআরএ) প্রকল্পের অর্থায়নে বাংলাদেশে এই প্রথম স্থানীয় ওয়ার্কশপে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে হোল ফিড কম্বাইন্ড হারভেস্টার ডিজাইনও তৈরি করেছেন ব্রির বিজ্ঞানীরা। ওই প্রকল্পের পরিচালক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম জানান, দেড় বছর ধরে গবেষণা করে যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলকে টার্গেট করে যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়। কারণ, বোরো মৌসুমে শ্রমিক সংকট এবং পাহাড়ি ঢলে প্রচুর ফসল নষ্ট হয়। তবে আমন এবং বোরো উভয় মৌসুমেও এ যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা যাবে। তবে এখনই বাজারে মিলবে না এই যন্ত্র। 

আরও পড়ুন

×