ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

‘ছিটের মানুষ’ মুসা আলী এখন পুলিশের সার্জেন্ট

‘ছিটের মানুষ’ মুসা আলী এখন পুলিশের সার্জেন্ট

মুসা আলী

শাহিনুর রহমান শাহিন, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম)

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০

দরিদ্র আবদুস ছোবান আলী শুঁটকির ব্যবসায়ী। সামান্য আয়ে সংসার চালান। জমিজমা নেই তেমন। বসতভিটার ৫ শতক জমিই সম্বল। তবে শৈশব থেকেই পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল ছোবানের একমাত্র ছেলে মুসা আলীর। এতে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়ায় জন্মস্থানের ভূরাজনৈতিক অবস্থান। মুসার বাড়ি যে দাসিয়ারছড়া ছিটমহলে! তারা বসবাস করত তৎকালীন ভারতীয় ভূভাগে। বাস্তবে তারা দেশহীন। নাগরিকত্ব ছিল না কোনো দেশেরই। আশপাশের মানুষের কাছে পরিচয় জুটেছিল যাদের ‘ছিটের মানুষ’ হিসেবে। সেই দাসিয়ারছড়ার মুসা বাংলাদেশ পুলিশে সার্জেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। গত ৯ জুলাই বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের সই করা প্রজ্ঞাপনে ২০২২ সালে সার্জেন্ট পদে নিয়োগের জন্য চূড়ান্তভাবে ৭২৬ জনকে নির্বাচিত করা হয়। এর মধ্যে ৫৩৩ নম্বর নামটি মুসা আলীর। তাঁকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে পদায়ন করা হয়েছে। এখন রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মুসা।

২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে ছিটমহলের বন্দিদশা শেষ হয় নিবাসীদের। ফলে ভারতের ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের চার জেলায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হয় দাসিয়ারছড়া। সেখানকার ৬ হাজার ৫২৯ জন অধিবাসী এখন বাংলাদেশের নাগরিক।

দাসিয়ারছড়া টংকার মোড়ের আবদুস ছোবান আলী-মনোয়ারা বেগম দম্পতির তিন সন্তানের দু’জন মেয়ে। একমাত্র ছেলে মুসার পড়াশোনা করার তীব্র ইচ্ছা ছিল। তবে ছিটমহলে কোনো বিদ্যালয় না থাকায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন শৈশবেই। হয়তো বাবার শুঁটকির ব্যবসায় ভবিষ্যৎ গড়ে নিতে হতো তাঁকে। কিন্তু লড়াকু মা মনোয়ারা ভিন্ন কৌশল নেন। বাংলাদেশের ভেতর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। তবে বুক ফুলিয়ে কথা বলার সাহস ছিল না মুসার। ‘ছিটের মানুষ’ পরিচয় গোপন করে যেতে হয়েছে।

পূর্বচন্দ্রখানা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করেন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মুসা আলী। সাইফুর রহমান সরকারি কলেজ থেকে ২০১৬ সালে পাস করেন এইচএসসি। পরে মুসা ভর্তি হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগে। অভাব-অনটনের কারণে রংপুরে কম্পিউটারে গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ করে আয় করতেন তিনি। অনার্স ও মাস্টার্স পাস করে ফেরেন বাড়িতে। নানা পদে চাকরির পরীক্ষা দিতে থাকেন মুসা। নিজ মেধায় পুলিশে সার্জেন্ট হিসেবে নিয়োগ চূড়ান্ত হয় তাঁর।

মোবাইল ফোনে মুসা আলী বলেন, ‘অসহায় পরিবার থেকে শুধু মেধা দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা পদে চাকরি হবে, তা কল্পনাও করতে পারিনি। ছিটমহল বিনিময় হওয়ায় আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে।’

মনোয়ারা বেগমের ভাষ্য, ‘আমরা লেখাপড়া করি নাই। আমার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে লেখাপড়া করানোর। খেয়ে না খেয়ে ছেলের লেখাপড়া চালিয়ে গেছি। আল্লাহ আমার স্বপ্ন পূরণ করেছেন।’

ফুলবাড়ী সদর ইউপি চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ বলেন, মুসা আলী তাঁর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। ছিটমহল বিনিময় হওয়ার পর দাসিয়ারছড়া থেকে প্রথম কেউ পুলিশ কর্মকর্তা হয়েছেন। বিষয়টি এলাকার জন্য গর্বের।

আরও পড়ুন

×