ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

কিডনি বিক্রি করতে হবে না উম্মেহানির

কিডনি বিক্রি করতে হবে না উম্মেহানির

আশরাফুল ইসলাম, বড়াইগ্রাম (নাটোর)

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০১৯ | ১৩:২২

ঋণ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন তিনি। কোনো অবলম্বন নেই তার, নেই কোনো ছায়াও। অগত্যা নিজের দেহের একটা অংশ, একটা কিডনি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। দ্বারে দ্বারে এর জন্য ঘুরেও ছিলেন। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা ইউনিয়নের মৃত জাকারিয়ার স্ত্রী উম্মেহানি বেগমের (৫৭) এভাবে কেটেছে বেশ ক'দিন। তবে এখন আর কিডনি বিক্রি করতে হবে না তাকে, যেতে হবে না আর কারও কাছে। সমাধান দিয়েছেন গুরুদাসপুরের ইউএনও তমাল হোসেন।

দিনমজুর ছিলেন উম্মেহানির স্বামী জাকারিয়া। দরিদ্র মানুষ। অন্যের পুকুর ধারে একচালা টিনের ঘরে ছিল তাদের আবাস। সঙ্গে এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তাদের পুরো সংসার। ছেলেটা গুরুদাসপুর কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেছেন ক'দিন আগে। ভেবেছিলেন ছেলে হাল ধরবে এবার। এর মধ্যে স্বামী আর নিজে দু'জনই হন পক্ষাঘাতে আক্রান্ত। গ্রামীণ ব্যাংক, ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ ও ব্র্যাক থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ করেন চিকিৎসার জন্য। ওই চিকিৎসাধীন অবস্থায়ই স্বামী মারা যান মাস তিনেক আগে। উম্মেহানি ঢাকায় দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরেন কিছুটা সুস্থ হয়ে। আবার ঋণ নেন তিনি, কোনো এক সুদের মহাজনের কাছ থেকে, ৩০ হাজার টাকা। মেয়ে জুলিয়াকে বিয়ে দেন তা দিয়ে।

কোনো চাকরি হচ্ছিল না ছেলে হারিস উদ্দিনের। ঋণ নেন তিনি আবার। এবার পুরো দুই লাখ। ছেলেকে ঢাকায় গিয়ে পাঠাও-উবারে মোটরসাইকেল চালানোর জন্য কিনে দেন একটি মোটরসাইকেল ও একটি স্মার্টফোন। উবারের আয়ে সংসার খরচ মিটিয়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল তার। এর মধ্যে অসুস্থ মাকে দেখতে এলে মহারাজপুরের এক পাওনাদার ৭০ হাজার টাকার জন্য আটকে দেন হারিসের মোটরসাইকেল।

ঋণের পর্ব দাঁড়ায় এবার চতুর্থ। অন্য এক ব্যক্তি থেকে ৭০ হাজার টাকা, ছাড়িয়ে আনেন ছেলের মোটরসাইকেল। একইদিনে কিস্তির টাকার জন্য তার পালিত ৫টি ছাগল নিয়ে চলে যায় অপর পাওনাদার। সব মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় তিন লাখ ১৫ হাজার।

চোখে অন্ধকার নিয়ে আলোর আশায় অবশেষে উম্মেহানি সিদ্ধান্ত নেন- কিডনি বিক্রি হবে একটা।

উম্মেহানির সিদ্ধান্তের ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। গুরুদাসপুরের ইউএনও তমাল হোসেনও শুনে ফেলেন তা। মঙ্গলবার দুপুরে এলাকায় যান তার সন্ধানে। উম্মেহানির বাড়িতে বসে তার জীবনে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা শোনেন মনোযোগ দিয়ে। জানতে চান কার কার কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে উম্মেহানি বেগমকে কিছু নগদ অর্থ প্রদানও করেন।

অফিসে ফিরে আসেন তমাল হোসেন। উম্মেহানির ঋণ নেওয়া সকল এনজিও প্রতিনিধি এবং ব্যক্তিগত ঋণদাতাদের আমন্ত্রণ জানান নিজ কার্যালয়ে। গতকাল বুধবার সবাই এলে উম্মেহানির জীবনে ঘটে যাওয়া বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলেন তিনি সবাইকে, অনুরোধ জানান তার সমুদয় ঋণ মাফ করে দেওয়ার। ইউএনও তমাল হোসেনের অনুরোধে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মাফ করে দেন উম্মেহানির সকল ঋণ।

সবশেষে কিছু জানতে চাওয়া উম্মেহানির কাছে। অশ্রুসজল চোখে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন তখন তিনি। আনন্দে বাকরুদ্ধ, বাষ্পরুদ্ধ ঠোঁটে বলতে পারেন না কিছুই।

ইউএনও তমাল হোসেন বলেন, 'সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে উম্মেহানির খোঁজ নিয়েছি এবং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছি।' উম্মেহানির ঋণ মাফ করে দেওয়া এনজিও এবং ব্যক্তিদের ধন্যবাদ জানাতে জানাতে তিনি বলেন, 'সামাজিক মানুষ হিসেবে আমাদের সবার এমনটাই করা উচিত।'

আরও পড়ুন

×