ভরা বর্ষায় বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা

প্রতীকী ছবি
সমকাল প্রতিবেদক ও রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০
ভারী বর্ষণে যখন দেশের এক প্রান্তে ডুবছে মাঠঘাট, তখন আরেক প্রান্তে বৃষ্টিশূন্য প্রকৃতি; শুকিয়ে চৌচির কৃষকের জমি। রোদে পুড়ছে চারপাশ। বৃষ্টির পানিতে দক্ষিণাঞ্চল টইটম্বুর হলেও পানি সংকটে ভুগছে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল। ঝুঁকিতে পড়েছে আমন চাষ। মাঝেমধ্যে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হলেও জমি ভিজছে না। পাট জাগ দেওয়ার পানিও নেই। এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষিরা।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি ক্রমে খারাপের দিকে যাচ্ছে; দেশে পানি সংকটাপন্ন অঞ্চলের পরিধি বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন, জলাশয় ভরাট ও গাছ কেটে ফেলার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে বর্ষাকাল উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
ঝুঁকিতে আমন চাষ, দিশেহারা কৃষক
কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ বছর রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় ৪ লাখ ৫ হাজার ৯ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ধান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে ১৩ লাখ ৮১ হাজার ৫৮৮ টন। কিন্তু পানির অভাবে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কৃষকরা বীজতলা রক্ষা করতে পারছেন না পানির অভাবে। অনেকে আমন চারা রোপণ করতে পারছেন না। আবার কেউ কেউ চারা রোপণ করে তা বাঁচাতে পারছেন না পানির সংকটে। বৃষ্টিনির্ভর আমন চাষ পুরোটাই সেচনির্ভর হয়ে পড়েছে। এতে ব্যয় বাড়ছে কৃষকের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৯ লাখ ৪৭ হাজার ১৬৩ হেক্টর জমির প্রায় ৩৩ শতাংশ বরেন্দ্র অঞ্চল। এ অঞ্চলের ৫৩ শতাংশ এলাকা উচ্চ বরেন্দ্র ও ৪৭ শতাংশ সমতলভূমি। বরেন্দ্র অঞ্চলে ৩৫ হাজার ৫৭০ হেক্টর কৃষিজমি শুধু বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুণ্ডুমালা এলাকার কৃষক সামসুজ্জোহা তাঁর সাত বিঘা জমির মধ্যে পাঁচ বিঘায় আমন চারা রোপণ করেছেন। কিন্তু চারা রোপণের পর আর বৃষ্টির দেখা নেই। পানির অভাবে জমি ফেটে গেছে, লালচে হয়ে চারা মরে যাচ্ছে। উপজেলার মানিককন্যা গ্রামের কৃষক মইনুদ্দিন বলেন, ‘একদিকে বৃষ্টির দেখা, অন্যদিকে জমিতে সেচের ব্যবস্থাও নেই।’ বৃষ্টি না হলে এবার বরেন্দ্র অঞ্চলে আমনের ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা করছেন তিনি।
তানোরের সমাসপুর গ্রামের কৃষক সুকুমার রবিদাস জানান, গত বছর আমন মৌসুমে বিঘাপ্রতি সেচ খরচ ছিল দুই হাজার টাকা। এ বছর সেই খরচ বেড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা হয়েছে। এক ঘণ্টা পানি নিলে পাম্প অপারেটরকে ২০০ টাকা দিতে হচ্ছে। অনেকে টাকা দিয়েও সময়মতো পানি পাচ্ছেন না।
নওগাঁয় বৃষ্টি না হওয়ায় মাঠের পর মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আমন চাষ হচ্ছে জমিতে সেচ দিয়ে। জেলার শিকারপুর গ্রামের কৃষক আবদুল মতিন জানান, সেখানে সেচ দিতে বিঘাপ্রতি খরচ পড়ছে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ধান আবাদ হয় নাচোল উপজেলায়। নাচোলের কৃষক মনিরুল ইসলাম জানান, তিনি এবার ১৫ বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছেন। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় বিপদে পড়েছেন। শিবগঞ্জের ধাইনগর গ্রামের কৃষক হোসেন আলী জানান, পানির অভাবে তাঁর পৌনে দুই বিঘা জমি পতিত রয়েছে।
ভরা বর্ষায়ও নাটোরের লালপুরে খাল-বিল পানিশূন্য। বৃষ্টি না থাকায় আমনের বীজতলা ফেটে যাচ্ছে। স্থানীয় কৃষক সাবাজ আলী বলেন, ‘অনেক জায়গায় বৃষ্টি হচ্ছে বলে শুনছি, কিন্তু লালপুরে বৃষ্টির দেখা নেই। ধানের জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।’
রাজশাহীতে কমছে বৃষ্টিপাত
২০২১ সালে বর্ষাকালে রাজশাহীতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, গত বছর ও চলতি বছর (২০২২-২৩) মিলিয়ে এখনও সেই পরিমাণ বৃষ্টি এ অঞ্চলে হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রাজশাহী অঞ্চলে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বৃষ্টি কমেছে। এবার বৃষ্টি আরও কমে পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ভরা বর্ষাতেও খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত জুলাইয়ে প্রায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এর মধ্যে রাজশাহীতে হয় ১৩৮ মিলিমিটার। চলতি মৌসুমে এ অঞ্চলের মাসিক গড় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় মাত্র ১৪০ মিলিমিটার। অথচ গত বছর জুলাই পর্যন্ত রাজশাহীতে মাসে গড় বৃষ্টিপাত ছিল ৩৬৬ মিলিমিটার। ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত রাজশাহীতে মাসে গড় বৃষ্টিপাত হয় ৮৫২ দশমিক ৯ মিলিমিটার। আর গত বছর ও চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এ অঞ্চলে মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ৭৬২ দশমিক ৭ মিলিমিটার।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক গাউসুজ্জামান বলেন, ‘বিগত বছরগুলোর তুলনায় রাজশাহীতে এবার বৃষ্টিপাত অনেক কম। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে। কেননা রাজশাহীতে যে পরিমাণ গাছ লাগানো হচ্ছে, তার চেয়ে কাটা হচ্ছে বেশি। নদীর নাব্যও কমেছে। সব মিলিয়ে জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমান উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে দেশে বৃষ্টিপাত কমেছে। গত দুই বছরে রাজশাহীতে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ বৃষ্টি কমেছে।’
সম্প্রতি ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) ‘উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতি নিয়ে হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং’ শীর্ষক গবেষণা করে। গবেষণাটি ২০১৮ সালে শুরু হয়ে চলতি বছরের জুনে ওয়ারপোর অনুমোদন পায়। গবেষণায় উঠে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। পানি সংকটাপন্ন এলাকার পরিধি বাড়ছে। খাবার পানি, সেচ, মাছ চাষের মতো কাজে ভূগর্ভস্থ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলায় পানির স্তর নেমে গেছে। ২০১০ সালে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৫০ ফুট নিচে। ২০২১ সালে তা আরও নেমে ৬০ ফুটে চলে যায়। একই বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামে ১৫৩ ফুট গভীরে। গবেষণার তথ্যমতে, এ অঞ্চলের ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮৭টি ‘অতি উচ্চ’ ও ‘উচ্চ’ পানি সংকটাপন্ন এলাকা।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, ‘এ বছর এল নিনো হচ্ছে। এ রকম হলে সাধারণত বৃষ্টিপাত কম হয়। আবার যেখানে হবে, সেখানে অতিবৃষ্টি বা বন্যা হয়ে যায়। কোনো কোনো অঞ্চলে আবার খরা দেখা দিতে পারে।’
ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার দাশ বলেন, প্রাকৃতিক নানা কারণে বাংলাদেশের একেক এলাকায় একেক সময় তাপপ্রবাহ বেশি হতো। কিন্তু দুই যুগ ধরে বড় বড় শহর, রাজশাহী বিভাগ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বেশি তাপদাহ হচ্ছে। মূলত এসব এলাকার নদনদী শুকিয়ে যাওয়া ও গাছপালা ব্যাপকভাবে কমার কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এসব এলাকায় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং দিন ও রাতে তাপমাত্রার পার্থক্য বেশি থাকছে। এটি মরু অঞ্চলের আবহাওয়ার লক্ষণ।’ আবহাওয়া স্বাভাবিক রাখতে এসব এলাকায় বেশি বেশি গাছ লাগানো ও নদী-জলাশয়ে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি।
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, ‘চলতি মাসে লঘুচাপ, নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সব প্রক্রিয়ার সময় বঙ্গোপসাগরের পানি বাষ্পীভূত হয়ে যে মেঘের সৃষ্টি করেছিল, তা উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। মিয়ানমারের আরাকান পর্বত, ভারতের ত্রিপুরা, গারো পাহাড়, মেঘালয় পর্বতের পাহাড়ি ঢাল বয়ে আকাশে উঠে ওই ঘন মেঘ বৃষ্টির সৃষ্টি করেছে। ফলে সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হচ্ছে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঘন মেঘ না আসায় রাজশাহী, খুলনা ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে বর্ষার দেখা নেই। তবে এ সপ্তাহে রাজশাহী বিভাগে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি]
- বিষয় :
- খরা