খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
রোগী জিম্মি করে আন্দোলন চলছেই

ইন্টার্ন চিকিৎসকদের লাগাতার কর্মবিরতিতে ভোগান্তিতে রোগীরা। বুধবার খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে - সমকাল
খুলনা ব্যুরো
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৩ | ২২:২৫ | আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০২৩ | ২২:২৫
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দু’দিন আগে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন সোহরাব হোসেন। জানালেন, মঙ্গলবার রাতে কোনো ডাক্তারকে দেখেননি। শুনেছেন ডাক্তারদের কর্মবিরতি চলছে। কোমরের হাড়ে সমস্যা থাকায় জাহানারা বেগমকে তিন দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করান তাঁর ছেলে মো. হযরত আলী। তিনি জানান, মঙ্গলবার রাতে ডাক্তার আসেননি। বুধবার সকালে ডাক্তার এসে জাহানারা বেগমকে দেখার পর ওষুধ লিখে দেন। কিন্তু হাসপাতালের সামনের দোকান বন্ধ থাকায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে গিয়ে ওষধু কিনতে হয়েছে।
শুধু তারাই নন, তিন দিন ধরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দেড় হাজার রোগী ও তাদের স্বজন। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের লাগাতার কর্মবিরতি ও মেডিকেলের সামনের ওষুধের দোকান বন্ধ থাকায় বেড়েছে রোগীদের দুর্ভোগ। গত সোমবার রাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ওষুধের দোকানিদের সংঘর্ষের জেরে সৃষ্টি হয়েছে এ পরিস্থিতি।
এদিকে বুধবার সকাল থেকে ক্লাস বর্জন করেন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। বেলা পৌনে ১১টায় তারা কলেজ ভবনের প্রধান গেটে তালা ঝুলিয়ে দেন। এ ছাড়া দিনভর কলেজের প্রধান গেটে অবস্থান করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা তিন দফা দাবি জানান। দাবির মধ্যে রয়েছে– হামলাকারী ওষুধের দোকানি ও কর্মচারীদের আটক করা, তিন দিনের মধ্যে হাসপাতালে দুটি মডেল ফার্মেসি চালু ও ক্যাম্পাসে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন।
বিক্ষোভের এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. দীন-উল-ইসলাম ও উপাধ্যক্ষ ডা. মেহেদী নেওয়াজ সেখানে আসেন। সংকট নিরসনে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন তারা। এর পর সেখানে আসেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. রবিউল হোসেন। তিনিও চাপের মুখে ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেন। তবে শিগগিরই মডেল ফার্মেসি চালু করার আশ্বাস দেন পরিচালক। বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ।
অবস্থান কর্মসূচি শেষে মেডিকেলের শিক্ষার্থী কোরাইশ হাসিব, মিঠুন ঘোষ, আশিকুন্নবী পিয়ালসহ কয়েকজন জানান, তারা হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য বৃহস্পতিবার (আজ) দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময় দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে তারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আমরণ অনশন শুরু করবেন। এ সময় জরুরি বিভাগে কাউকে ঢুকতে বা বের হতে দেওয়া হবে না।
হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. সাইফুল ইসলাম অন্তর বলেন, গত সোমবার রাত থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতিতে আছেন। হামলাকারীরা আটক না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবর পেয়ে হাসপাতালের সামনের ওষুধের দোকানগুলোর পাশে জড়ো হন দোকান মালিক, কর্মচারী ও তাদের লোকজন। দিনভর সেখানে তারাও বিক্ষোভ করেন।
বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির খুলনা শাখার সহসভাপতি এস এম কবীর উদ্দিন বাবলু ও কেন্দ্রীয় পরিচালক জিল্লুর রহমান জুয়েল বলেন, দোকানিদের ওপর হামলা, মারধর ও দোকান ভাঙচুরের প্রতিবাদে তারা তিন দিন ধরে হাসপাতালের সামনের ৯০টি দোকান বন্ধ রেখেছেন। হামলাকারী শিক্ষার্থীদের আটক না করা পর্যন্ত তাদের ধর্মঘট চলবে।
এদিকে রোগী ও তাদের স্বজনের অভিযোগ, তিন দিন ধরে সংকট চললেও তা নিরসনে স্বাস্থ্য বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এতে তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন।
গতকাল সকালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের প্রধান গেটে ১৩-১৪ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছেন। পরে দু’পক্ষের বিক্ষোভে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে আরও পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
হাসপাতালের পরিচালক রবিউল হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের ৩ দফা দাবির মধ্যে মডেল ফার্মেসি শিগগিরই চালু করা হবে। হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও পুলিশ ফাঁড়ির বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে রোগীদের দুর্ভোগ ও অন্য চিকিৎসকদের ওপর চাপ বেড়েছে। তারা পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছেন।
কলেজের অধ্যক্ষ দীন-উল-ইসলাম জানান, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় কলেজের সচিব মো. মনিরুজ্জামান বাদী হয়ে মঙ্গলবার রাতে সোনাডাঙ্গা থানায় একটি এজাহার দেন। এতে আসামি হিসেবে চারজনের নাম ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৫০ জনের কথা উল্লেখ করা হয়।
এ ব্যাপারে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (সাউথ) মো. তাজুল ইসলাম জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মেডিকেলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এজাহার পেয়েছি, মামলা রেকর্ড করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তারা হামলাকারীদের আটক করার জন্য চেষ্টা করছেন।
গত সোমবার রাতে হাসপাতালের সামনে একটি দোকানে ওষুধ কিনতে যান মেডিকেলের শিক্ষার্থী হাসান ফেরদৌস। দোকানি এক পাতা ওষুধের দাম ৭০ টাকা জানালে হাসান ১০ শতাংশ কমিশন বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানান। এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার এক পর্যায়ে দোকান মালিক তাঁকে অপমান করেন। এর পর ওই শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে গিয়ে জানালে অন্য শিক্ষার্থীরা ওই দোকানে যান। বাগ্বিতণ্ডার এক পর্যায়ে ওষুধের দোকানিদের সঙ্গে ছাত্রদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়।
রোগীদের জিম্মি করে আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন
দু’পক্ষই মূলত রোগীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করায় এই আন্দোলনের যৌক্তিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটি খুলনার সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা সমকালকে বলেন, রোগীদের জিম্মি করে দু’পক্ষের আন্দোলনই অনৈতিক। ওষুধ বিক্রির জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। ইচ্ছা হলো ওষুধ বিক্রি করলাম না, এটা করার সুযোগ নেই। ওষুধ প্রশাসনের উচিত, এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া। অন্যদিকে চিকিৎসক বা ছাত্রদের ওপর কোনো অন্যায় হলেই চিকিৎসা বন্ধের যে অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে, এ থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যসেবা গ্রহীতা ফোরাম খুলনা জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, মানুষকে জিম্মি করে আন্দোলনে নামা অনৈতিক। নিজেদের ওপর অন্যায়ের বিচার চাইতে গিয়ে ফার্মেসি মালিক ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা রোগীদের ওপর অন্যায় করছেন। দু’পক্ষেরই আগে কাজে ফেরা উচিত। পরে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
তবে চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএর জেলা সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই চাই না, রোগীদের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হোক। কিন্তু মেডিকেলে পড়তে এসে শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের শিকার হবে, মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হবে– দিনের পর দিন এটা চলতে পারে না। ঘটনার পর থেকে পুলিশ প্রশাসন দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে। বিএমএর জরুরি সভায় আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’