বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের অন্দরমহল: প্রথম পর্ব
বয়স্ক বাঘ-সিংহ থাকে আড়ালে

ইজাজ আহ্মেদ মিলন, গাজীপুর
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৩ | ০৫:০৪ | আপডেট: ১৭ আগস্ট ২০২৩ | ০৫:০৪
১১টি জেব্রা, একটি বাঘ ও একটি সিংহীর মৃত্যুর ঘটনায় ২০২২ সালের প্রথম দিকে আলোচনায় আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের অদূরে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় পার্কটির অবস্থান। ১৩টি প্রাণীর মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশের পর সেখানকার নানা অব্যবস্থাপনা আর অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তবে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে অতীতের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। পার্ককে ছন্দে ফেরাতে আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে।
৮ বাঘ আর ৬ সিংহ
পার্কের ভেতরে একটি এলাকাজুড়ে রয়েছে কোর সাফারি। এই এলাকা বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। রয়েছে আফ্রিকান কোর সাফারি, ডিয়ার সাফারি, এশিয়াটিক ডিয়ার ব্ল্যাক সাফারি, লায়ন সাফারি ও টাইগার সাফারি।
আফ্রিকান সাফারিতে রয়েছে জিরাফ, জেব্রা, ওয়াইল্ডবিস্টের মতো প্রাণী। ডিয়ার সাফারিতে রয়েছে শতাধিক চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ ও সাম্বার হরিণ। এশিয়াটিক ব্ল্যাক সাফারিতে ভালুক, লায়ন সাফারিতে সিংহ ও টাইগার সাফারিতে বাঘ রাখা হয়েছে।
দর্শনার্থীদের প্রধান আকর্ষণ বাঘ ও সিংহ। হিংস্র প্রজাতির এ দুই প্রাণীর দেখা পেলেই তৃপ্তি মেটে। কিন্তু সাফারি পার্কের বিশাল এলাকায় বাঘ ও সিংহের দেখা পাওয়া সহজ নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনা কয়েকটি বাঘ ও সিংহ বিভিন্ন সময় মারা গেছে। বর্তমানে পার্কে বাঘ রয়েছে ৮টি। এর মধ্যে ৬টিই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অসুস্থই থাকে বেশির ভাগ সময়। আর ৬টি সিংহের ৪টিই বয়স্ক। রোগ-ব্যাধি পিছু ছাড়ছে না তাদেরও। ফলে বাঘ ও সিংহ বেশির ভাগ সময়ই থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে।
যা বলছেন দর্শনার্থীরা
সম্প্রতি নরসিংদী থেকে সাফারি পার্কে আসেন আলী হোসেন। বছর পাঁচেক আগে বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিলেন তিনি। তখন বেশ অগোছালো ছিল বলে জানান। এবার পরিবার নিয়ে এসে দেখেন, পার্ক আগের তুলনায় বেশ পরিপাটি। সবকিছুই ভালো লেগেছে তাদের। তবে বাঘ-সিংহ দেখতে না পারায় আক্ষেপের কথা জানান।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে এসেছিলেন স্কুলশিক্ষক হোসনে আরা বেগম। ঘুরে ঘুরে প্রাণী দেখে তৃপ্তির কথা জানান তিনি। তাঁরও আফসোস ছিল বাঘ-সিংহের দেখা না পেয়ে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শ্রীপুরে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক’ স্থাপনের প্রকল্পটি সরকার হাতে নেয় ২০১০ সালে। উপজেলার ইন্দ্রবপুর গ্রামে ৩৮১০ একর জমিতে পার্ক স্থাপনের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ৬৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। প্রকল্প শেষের মেয়াদ ধরা হয় ৩৪ মাস। ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল কাজ। তবে নানা অজুহাতে এর মেয়াদ বাড়ানো হয়। প্রকল্পটি শেষ হয় ৯ বছরে, ব্যয় বাড়ে ৪০৯ শতাংশ। সব মিলিয়ে খরচ হয় ৩২৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ২১৭টি অঙ্গে ভাগ করার মাধ্যমে কাজ চালিয়ে অবশেষে ২০১৮ সালের জুন মাসে প্রকল্পের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ২০১৯ সালের শেষের দিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) প্রতিবেদন জমা দেয় বন অধিদপ্তর।
১১টি জেব্রার মৃত্যুর বিষয়টি গত বছর আড়াল করার চেষ্টা হয়েছিল। কর্মকর্তারা স্বাভাবিক ঘটনা বলে চালিয়েও দিতে চেয়েছিলেন বিষয়টিকে। ওই ঘটনায় আলোড়ন তৈরি হয়। জানা গেছে, এখন পার্কে জেব্রা রয়েছে ২৬টি। এর ৮টিই জন্ম নিয়েছে পার্কে। ওয়াইল্ডবিস্ট রয়েছে ১১টি।
পার্কের দায়িত্বে থাকা সহকারী বন সংরক্ষক মো. রফিকুল ইসলামের ভাষ্য, তারা পুরো পার্ককে ছন্দে আনার চেষ্টা করছেন। এতে দর্শনার্থীরাও স্বস্তি পাচ্ছেন। তবে পার্ককে আরও আকর্ষণীয় করতে বাঘ-সিংহ বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
রফিকুল জানান, বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়া তিনটি নীলগাই পার্কে আনা হয়। এখানে আরও তিনটি শাবকের জন্ম হয়েছে। তিনটি মাদি জিরাফ রয়েছে। তবে পুরুষ জিরাফ নেই। ভালুক রয়েছে ১৫টি। এর মধ্যে জন্মান্ধ একটি ভালুক দর্শনার্থীদের বাড়তি আনন্দ দেয়। হাতি রয়েছে ৮টি। পার্কে আনা দুর্লভ প্রজাতির সব প্রাণীই বংশবিস্তার করছে জানিয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, আরও কিছু দুর্লভ প্রাণী আনার পরিকল্পনা করছেন। সব মিলিয়ে এখন সাফারি পার্কে নানা জাতের প্রাণীর সংখ্যা আনুমানিক ৩ হাজার।
পার্ক ঘুরে দেখা গেছে, আগে এক বেষ্টনীর প্রাণীর অন্য বেষ্টনীতে যাওয়ার অবাধ সুযোগ ছিল। এখন আর সে সুযোগ নেই। প্রতিটি প্রাণীর জন্য পৃথক বেষ্টনী করা হয়েছে। ফলে প্রাণীগুলোর মধ্যে সংঘাত বন্ধ হয়েছে। পুরো পার্কই এখন সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায়। কোনো প্রাণীর সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি হাজির হন। কর্মকর্তারা বলছেন, আগে প্রাণীগুলোর যেখানে-সেখানে মাটিতে খাবার দেওয়া হতো। এখন আলাদা ট্রেতে খাবার দেওয়া হয়। পানি পানের জন্য পৃথক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
জানা যায়, শুরুর দিকে কলাবাগান তৈরিতে ৫ লাখ টাকা ও বাঁশবাগান সৃজনে ৫ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছিল। অথচ কোনো বাগানই করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। পার্কে শুরুর দিকে ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২১০ ফুট দীর্ঘ একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মিত হয়। কিছুদিন পরই সেটি ভেঙে যায়। সম্প্রতি সেটি মেরামত করা হয়েছে। অনুপযোগী হয়ে যাওয়া শৌচাগার সম্প্রতি মেরামত করা হয়েছে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা শারমীন আক্তার সম্প্রতি পার্ক দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি বলেন, কীভাবে পার্কের আরও আধুনিকায়ন করা যায়, তা নিয়ে ভাবছেন। এ বিষয়ে বেশকিছু পরিকল্পনা রয়েছে।
- বিষয় :
- বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক
- বাঘ
- সিংহ
- ঢাকা