কারাগারে কাঁদছে ছোট্ট মৌ
ডিএনসির ‘সাজানো অভিযানে’ তছনছ গোছানো সংসার

মায়ের কোলে শিশু মৌ। ছবি-সমকাল
রহিম রেজা, রাজাপুর (ঝালকাঠি)
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ০০:৩১
ঝালকাঠির রাজাপুরে অভিযান চালিয়ে গত বুধবার রাতে আগ্নেয়াস্ত্র, মাদকসহ রোজিনা বেগম (২৮) ও তাঁর তিন বছরের মেয়ে নুসরাত ফারিয়া মৌকে আটক করে বরিশাল বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গোয়েন্দা শাখা। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার তাদের রাজাপুর থানায় হস্তান্তর ও ডিএনসি বরিশাল বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার এসআই ইশতিয়াক হোসেন পৃথক মামলা করেন। এতে রোজিনাকে প্রধান ও তাঁর স্বামী আলামিন হোসেনকে দুই নম্বর আসামি করা হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে পুলিশ মা-মেয়েকে কারাগারে পাঠায়। পলাতক আলামিন।
ঝালকাঠি ডিএনসিকে না জানিয়ে বরিশাল বিভাগীয় দলের এ অভিযান নিয়ে স্বজনরা আগেই প্রশ্ন তোলেন। এবার মামলার এজাহারের সঙ্গে সাক্ষীদের বক্তব্যের গরমিল পাওয়া গেছে। মামলায় মোট তিনজনকে সাক্ষী করেছেন এসআই ইশতিয়াক। তাদের মধ্যে দু’জন সমকালকে জানিয়েছেন, রোজিনা অস্ত্র ও মাদক কারবারে জড়িত বলে তাদেরও বিশ্বাস হচ্ছে না। অভিযানকে ‘সাজানো নাটক’ বলেও দাবি করেন সাক্ষীরা।
অস্ত্র ও মাদক মামলার এক নম্বর সাক্ষী মোস্তফা বেপারী বলেছেন, ‘বরিশাল বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার একটি দল বুধবার বিকেলে আলামিনের বাড়িতে এসে খড়ের গাদা থেকে একটি দেশে তৈরি পিস্তল, ১০ রাউন্ড গুলি ও ১৫ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করে, যা উপস্থিত সবাই দেখেছেন। সন্ধ্যার পরে ঘরে তল্লাশি করা হবে বলে আমাকে ডেকে নেয়। আলামিনের বসতঘরে কাপড় রাখার ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ার খুলে অস্ত্র, গুলি ও ফেনসিডিল বের করা হয়। খড়ের গাদা থেকে উদ্ধার অস্ত্র ও মাদক কীভাবে ঘরে গেল, তা আমি জানি না। পরে শুনেছি, আমাকে এ মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে।’
তিন নম্বর সাক্ষী রাব্বি হাওলাদার বলেন, ‘বুধবার বিকেলে দোকান থেকে ডেকে নিয়ে গোয়েন্দারা অস্ত্র ও ফেনসিডিল দেখান। সেগুলো আলামিনের ঘরের সিঁড়িতে সাজানো ছিল। উপস্থিত লোকজন জানান, এগুলো খড়ের গাদায় পাওয়া গেছে। এর পর দোকানে ফিরে আসি। পরে সন্ধ্যায় আবারও ঘরে তল্লাশির কথা বলে ডেকে নেন এবং এক পর্যায়ে ঘর থেকে অস্ত্র, গুলি ও ফেনসিডিলগুলো বের করে আনেন তারা।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি জানতে চাই, তাহলে তো দুটি পিস্তল উদ্ধার হলো। পরে খেয়াল করে দেখি, সিঁড়ির সেই পিস্তলই ঘর থেকে বের করেছেন গোয়েন্দারা। এ সময় আমি সাক্ষী দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে টাকা দিতে চান। ফোন দিলেই আদালতে যেতে হুমকি দেন এবং খরচাপাতি দেবেন বলে জানান। ওই ঘর দূরে থাক, বাড়িতেও অস্ত্র, গুলি কিংবা ফেনসিডিল থাকতে পারে– আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
গতকাল বাদী এসআই ইশতিয়াক হোসেনের নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করা হয়নি। তবে আগের দিন তিনি বলেছিলেন, ‘আলামিন যশোরের বেনাপোল থেকে মাদক এনে বিভিন্ন স্থানে চড়া দামে বিক্রি করেন। তিনি এলাকায় বড় মাপের মাদক কারবারি হিসেবে পরিচিত। স্বামীর অনুপস্থিতিতে রোজিনা এ কারবার চালান। ক্রেতা সেজে তাঁর কাছ থেকে আমরা মাদক নিয়েছি। কারও প্রভাবে নয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়েছে।’
অস্ত্র আইনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজাপুর থানার এসআই মামুন হোসেন জানান, তদন্তে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। মামলার অপর আসামি আলামিনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পরিচালক পরিতোষ কুমার কুণ্ডু বলেছেন, রাজাপুর থানা বিষয়টি তদন্ত করছে। আশা করছি, সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে এবং আদালতে উভয় পক্ষ ন্যায়বিচার পাবে। আসামি ও তাদের স্বজনরা নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণে অনেক কথা বলতেই পারেন, এসব আমরা আমলে নিচ্ছি না।
এদিকে রোজিনার স্বজনরা জানিয়েছেন, মিথ্যা অভিযোগে একটি পরিবার তছনছ হয়ে যেতে বসেছে। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আলামিন পলাতক। ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে মা কারাগারে দিন পার করছেন। গতকাল ঝালকাঠি জেলা কারাগারে গিয়ে রোজিনার সঙ্গে দেখা করেন পরিবারের সদস্যরা। এ সময় মৌ কান্না করে। বন্দি জায়গায় সে থাকতে চাইছে না। বারবার কান্নার মধ্যে বাবার কাছে ফিরতে চাইছে।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে রাজাপুরের গালুয়া ইউনিয়নের কানুদাশকাঠি গ্রামে গিয়ে কথা হয় রোজিনার বড় বোন আসমা বেগম, ভাবি মনোয়ারা বেগম, মামা সিদ্দিকুর রহমান, বাবা বারেক মিয়া, ভাই জুয়েল মিয়াসহ স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে। তারা জানান, প্রথমে তো অভিযানে বসতঘরে কোনো অস্ত্র, গুলি ও ফেনসিডিল পায়নি। বাড়ির উঠানের দক্ষিণ পাশের খড়ের গাদার মধ্য থেকে এসব উদ্ধার করা হয় এবং ঘরের সিঁড়িতে সাজিয়েও রাখে। কিন্তু সন্ধ্যার পর সব উল্টে যায়। এখন দেখছি, মামলায়ও ঘর থেকে আগ্নেয়াস্ত্র-মাদক উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। অভিযানের সময় কাউকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এমনকি নারীদের মারধর ও ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। কেউ ষড়যন্ত্র করে ফাঁসাচ্ছে কিনা, তা তদন্তের দাবি জানান স্বজনরা। একই সঙ্গে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানান তারা।
রাজাপুর থানার ওসি পুলক চন্দ্র রায় জানান, রোজিনার নামে আগের কোনো মামলা নেই। তবে তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে ঝালকাঠি সদরে একটি ও রাজাপুর থানায় দুটি মাদক মামলা রয়েছে।