ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পুলিশ হেফাজতে মৃত সাবেক দুদক কর্মকর্তা গ্রেপ্তার ছিলেন ‘গায়েবি মামলায়’

পুলিশ হেফাজতে মৃত সাবেক দুদক কর্মকর্তা গ্রেপ্তার ছিলেন ‘গায়েবি মামলায়’

ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লা। ফাইল ছবি

আব্দুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৩ | ১৭:১৩ | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৩ | ১৭:৫৫

চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক উপপরিচালক ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লা (৬৭) গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বলে জানা গেছে। গত মঙ্গলবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের এক ঘণ্টার মধ্যে তার মৃত্যু হয়।

গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রামে আদালতে দায়ের হওয়া মামলাটির বাদি রণি আক্তার তানিয়াকে (২৬) চেনেন না নিহত শহীদুল্লা’র স্বজনরা। তাদের দাবি, হয়রানির জন্য প্রতিপক্ষের লোকজন বাদিকে দিয়ে গায়েবি মামলাটি দায়ের করেছিল। সমকাল প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবেও অসংলগ্ন তথ্য দিয়েছেন শহীদুল্লার বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার দাবি করা মামলার বাদি তানিয়া। এদিকে শহীদুল্লাকে গ্রেপ্তারে বিধিবর্হিভূত কোনো কাজ হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখেতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।

মামলার এজাহার ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানার তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম ৬ষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে ৩২৩ (মারধর) ও ৫০৬ (২) (ভয়ভীতি প্রদর্শন) ধারায় মামলা করেন রণি আক্তার তানিয়া। মামলায় শহীদুল্লা ও তার শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ারকে আসামি করা হয়। গত ২৭ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। পরোয়ানাটি গত ১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানায় আসে। পরদিন পরোয়ানা তামিল করতে থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ইউসুফ আলীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ইউসুফ আলী ও আরেক এএএসআই মো. সোহেল গিয়ে নগরের পূর্ব ষোলশহর মোজাহের উল্লাহ মুহুরী বাড়ির পুকুরপাড় এলাকা থেকে দুদকের অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচালককে গ্রেপ্তার করেন।

মামলার এজাহারে বাদি তার পরিচয় উল্লেখ করেছেন তিনি বাঁশখালী উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের রত্মপুর গ্রামের মোহাম্মদ হাশেমের মেয়ে। নগরের এক কিলোমিটার এলাকায় দুলু মিস্ত্রির বাড়িতে থাকেন তিনি। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, গত জানুয়ারি থেকে তিন হাজার টাকা বেতনে তিনি ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লার বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। প্রথম দুই মাস বেতন ঠিকমতো দিলেও মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত তার বেতন বকেয়া ছিল। গত ১২ আগস্ট বকেয়া টাকা চাইলে ওই সপ্তাহের মধ্যে টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন শহীদুল্লা। একই সঙ্গে তার ভবনের নিচতলায় থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেও তাকে জানান। টাকা না দেওয়ায় ২৩ আগস্ট সকালে আবার টাকা চাইতে যান। এ সময় শহীদুল্লার স্ত্রী তাকে রাতে যেতে বলেন। রাতে টাকার জন্য গেলে শহীদুল্লা কেন রাতে বাসায় আসছেন জানতে চান। এসময় রাতে কাউকে টাকা দেন না বলেও তাকে জানান। তানিয়া তার মেয়ের জন্য দুধ কিনতে হবে তাই টাকা ছাড়া যাবেন না বলে জানালে শহীদুল্লা তাকে চড়-থাপ্পড় মারেন, ধাক্কা দিয়ে ফেলেও দেন। একপর্যায়ে তার নির্দেশে তার শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ার তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। এ সময় তার সঙ্গে থাকা কলি আক্তার নামে গর্ভবতী এক নারীকেও পেটে লাথি মারেন বলে অভিযোগ করেন তানিয়া।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কায়সার আনোয়ার বলেন, ‘আমার বোনের বাসায় গত দুই বছরে রণি আক্তার তানিয়া নামে কোনো মেয়ে গৃহকর্মী ছিল না। আমরাও তাকে চিনি না। মামলার বিষয়টিও মঙ্গলবার রাতের আগে জানতাম না। কোনো নোটিসও আমরা পাইনি। আমার দুলাভাইয়ের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যক্তির জায়গা জমি নিয়ে বিরোধ আছে। কিন্তু কোনো নারীর সঙ্গেতো সমস্যা নেই। এটি সম্পূর্ণ গায়েবি মামলা।’

স্থানীয়ভাবে খবর নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে জায়গা-জমি নিয়ে এস এম শহীদুল্লার সঙ্গে একই এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান আসাদের বিরোধ চলছে। এ নিয়ে কয়েকটি মামলাও রয়েছে। শহীদুল্লার ছেলে নাফিস শহীদ বলেন, ‘যার সঙ্গে জায়গা জমি নিয়ে বিরোধ চলছে, তিনি প্রভাবশালী। তার ইন্ধনে গায়েবি মামলাটি করা হয়েছে। রণি আক্তার তানিয়া নামে আমাদের কোন গৃহকর্মী কখনো ছিল না। আমরা এই নামে কাউকে চিনিও না। গায়েবি মামলা দিয়ে আমার বাবাকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘আমার সঙ্গে বিরোধ ছিল এটা ঠিক। কথাবার্তা হতো না, কিন্তু গত তিন-চারবছর ধরে কোনো ঝামেলা নেই। উনাকে যে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমি গত এক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ। বাসা থেকেও বের হইনি। তিনি আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। উনি আমার জেঠাতো ভাই। আমি একটি মামলাও তার বিরুদ্ধে করিনি। তাছাড়া কে মামলা করেছে সেটি চাইলে পুলিশ তদন্ত করে বের করতে পারে।’

মামলার এজাহারে বাদির উল্লেখ করা নম্বরে ফোন করা হলে এক নারী রিসিভ করেন। তিনি নিজেকে রণি আক্তার তানিয়া বলে পরিচয় দেন। তিনি শহীদুল্লার বাড়িতে গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন বলে দাবি করেন। তার কাছে শহীদুল্লার পরিবার কয়তলা ভবনে থাকেন জানতে চাইলে তিনি জানান দোতলা। অথচ শহীদুল্লাদের ভবনটি চারতলা। শহীদুল্লার পরিবার কোন তলায় থাকতেন জানতে চাইলে তিনি জানান দোতলায়। অথচ শহীদুল্লার পরিবার থাকেন নিচতলায়। কার ইন্ধনে মামলাটি করেছেন জানতে চাইলে তিনি মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

শহীদুল্লার পারিবারিক ভবনটির চারতলায় থাকেন তার ছোট ভাই এস এম সাইফুল্লাহর পরিবার। সাইফুল্লাহর ছেলে ছৈয়দ সাকিব আহমেদ বলেন, ‘বাদি হিসেবে যে নারীর নাম বলা হচ্ছে এই নামে কেউ আমার চাচার ঘরে গৃহকর্মী ছিলেন না। আমরা কখনো দেখিনি। এটি আমার চাচাকে হয়রানি করতে করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ততো এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে প্রাণ হারালেন তিনি।’

এদিকে শহীদুল্লাকে গ্রেপ্তারে কোনো বিধি বহির্ভূত কাজ হয়েছে কিনা এবং থানায় নিয়ে আসার পর তার সঙ্গে নিয়মবহির্র্ভূত কোনো আচরণ করা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি-উত্তর) উপকমিশনারকে প্রধান, অতিরিক্ত উপকমিশনারকে (উত্তর) সদস্য সচিব এবং সহকারী পুলিশ কমিশনারকে (সিটিএসবি) সদস্য করা হয়েছে। কমিটিকে তিনদিনের মধ্যে অনুসন্ধান করে মতামতসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়।

জানতে চাইলে সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (জনসংযোগ) স্পিনা রানী প্রামাণিক বলেন, ‘ওয়ারেন্টে তো মামলার ধারা ছাড়া অন্য কোনো তথ্য থাকে না। শুধু আসামির নাম-ঠিকানা থাকে। আদালত থেকে পরোয়ানা তামিলের আদেশ আসলে তো তলব করা পুলিশের দায়িত্ব। মামলা ও বাদি সম্পর্কে তো জানার সুযোগ থাকে না। এখানে শুধু আদালতের আদেশ তামিল করেছে পুলিশ।’

আরও পড়ুন

×