কপর্দকহীন থেকে কোটিপতি

লিমন বাসার, উত্তরাঞ্চল
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৩ | ০৭:০৫
ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যপদে হেরে পরেরবার লড়েন ইউপি চেয়ারম্যান পদে; সেখানেও বড় পরাজয়। ২০০৯ সালে আর ইউনিয়নে নয়, এবার সরাসরি উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার লড়াইয়ে। ভোট জুটেছিল মাত্র ১৭! এমন গো-হারা হেরেও মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন ভোটের মাঠে। গেল জাতীয় সংসদের ভোটে সব হিসাব-কিতাব বদলে দিলেন রেজাউল করিম বাবলু। জিরো থেকে হলেন হিরো। এখন তিনি বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি)। উপজেলায় যে প্রার্থীর রয়েছে ১৭ ভোটের কলঙ্ক, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর বাক্সেই এক লাখ ৯০ হাজার ভোট!
ক্ষণে ক্ষণে নিজের খোলস পাল্টাতে দারুণ পটু এই এমপি। আগে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা কামাতেন। মানুষ ঠকিয়ে একসময় ভাঙা মোটরসাইকেল কিনেছিলেন। এখন সেই বাবলু চড়েন বিলাসবহুল ল্যান্ডক্রুজারে। এমপি হওয়ার পর সরকারি প্রকল্প ‘বিক্রির হাট’ বসিয়েছেন। গ্রামে নামে-বেনামে অঢেল সম্পত্তি। ঢাকায়ও একাধিক গাড়ি-বাড়ি। গেল পাঁচ বছরে শত শত মানুষ প্রকল্প পেতে তাঁর কাছে আগাম টাকা দিয়ে অনেকেই খেয়েছেন ধরা। বাবলুর সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুদকও। আর ভুক্তভোগীরা এই এমপির বিচারের দাবিতে নেমেছেন পথে; দিচ্ছেন স্লোগান, পোড়াচ্ছেন কুশপুতুল।
শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভূমি) শানজিদা মুস্তারী বলেন, সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ জানিয়ে এলাকাবাসী বিক্ষোভ শেষে উপজেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। তবে এ নিয়ে এখনও বিস্তারিত কিছু জানি না। তাদের লিখিত অভিযোগটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি।
প্রকল্প বিক্রির নানা অভিযোগ
অভিযোগ রয়েছে, কোনো প্রকল্পের নথিতে টাকা ছাড়া সই করেন না এমপি বাবলু। মাঝিড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মজিবর রহমান বলেন, ‘মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, মন্দির– কোনো কিছুতেই ছাড় নেই। ধর্মীয় কাজেও তাঁকে আগাম টাকা দিতে হয়। এমনকি পাড়া-মহল্লার টিউবওয়েল, সৌরবিদ্যুতের জন্যও দুই থেকে তিন হাজার টাকা নেন এমপি। এ ছাড়া ৪৫ হাজার টাকার টিআর, কাবিখা প্রকল্প নিতে তাঁর কাছে থেকে আগাম ১৫ হাজার টাকায় স্লিপ কিনতে হয়। তবে বেশির ভাগ সময় টাকা নিয়েও ঠিকমতো কাজ দেন না। বেশি টাকা পেলে প্রকল্প অন্যজনের কাছে বিক্রি করে দেন।’
শাজাহানপুর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক বাদশা আলমগীর বলেন, ‘কাবিখা-কাবিটা মাটিকাটার প্রকল্প দেওয়ার কথা বলে এমপি আমার কাছ থেকে চার লাখ টাকা নিয়েছেন। সেই টাকাও আমি পাইনি; প্রকল্পও হাওয়া হয়ে গেছে। আমার প্রকল্প অন্যের কাছে বিক্রি করেছেন। এলাকার এমন কেউ নেই, যার টাকা তিনি লুটেপুটে খাননি।’ শাজাহানপুর উপজেলার সাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা মিঠু মিয়াকে ১২টি প্রকল্প দেওয়ার কথা ছিল। তিনি এমপির কাছে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা দেন। কিছুদিন পর প্রকল্পের তালিকা খুঁজতে গিয়ে দেখেন, মিঠুর নাম নেই। ঘুষের টাকা ফেরত নিতে দীর্ঘদিন ধরনা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি।
গাবতলীর আজিজুল হাকিম বলেন, কাবিখা, কাবিটা, টিআর, এডিবি, সৌর প্যানেল, টিউবওয়েলসহ সরকারের যত প্রকল্প– সবকিছুতেই তাঁকে খুশি করতে হয়। আমিও তাঁর পিএস রেজাউলের মাধ্যমে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়েছি। এখন টাকা হারিয়ে আমি নিঃস্ব। সম্প্রতি এমপি বাবলুর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের প্রতিবাদে এলাকাবাসী উপজেলা পরিষদের সামনে মানববন্ধন করে। সেখানে মাঝিড়া ইউনিয়নের ডোমনপুকুর বাইতুন নূর জামে মসজিদের সেক্রেটারি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমার মসজিদের নামে টিআর বরাদ্দের ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে মাত্র ১৫ হাজার টাকা পেয়েছি। বাকি ১ লাখ ৫ হাজার টাকা এমপি তাঁর জামাইয়ের মাধ্যমে মসজিদের ব্যাংকের হিসাব থেকে কৌশলে তুলে নিয়েছেন।
শূন্য থেকে শতকোটির মালিক
বগুড়া থেকে প্রকাশিত একটি আঞ্চলিক দৈনিকের শাজাহানপুর উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন বাবলু। সেখানে শুধু এক হাজার টাকা সম্মানী ভাতা দেওয়া হতো। একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তাঁর পেশা দেখানো হয় ব্যবসা ও সাংবাদিকতা। বার্ষিক আয় ছিল পাঁচ হাজার টাকা। সে হিসাবে তাঁর মাসিক আয় ৪১৭ টাকা। আয়ের উৎস ছিল কৃষি ও ব্যবসা। কৃষি খাত থেকে তিন হাজার টাকা। আর ব্যবসা থেকে দুই হাজার টাকা। নগদ টাকা ছিল ৩০ হাজার। ব্যাংকে জমার পরিমাণও ছিল ৩০ হাজার টাকা।
পাঁচ বছর পর উল্টে গেছে গণেশ! বাবলু নিজে ও পরিবারের সদস্যরা হঠাৎ ‘বড়লোক’ বনে গেছেন। শাজাহানপুরের এক ইউপি সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাবলু তাঁর চার মেয়েকে জমি কিনে চারটি বিশাল বাড়ি করে দিয়েছেন। এমপি হওয়ার পর বাড়ির সামনের সড়কের নামকরণ করেছেন ‘এমপি রোড’। এ সড়কে তাঁর বাড়ির নাম ‘গুলবাগী মঞ্জিল’। বাড়ির পাশে ডোমনপুকুর মৌজায় পৌনে ৫ শতাংশ জমি কিনেছেন। এ ছাড়া মাঝিড়া বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে নিজের টাকায় জায়গা কিনেছেন। ঢাকার পান্থপথ ও গাজীপুরে ফ্ল্যাট, শুল্কমুক্ত কোটি টাকার গাড়ি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি গাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া শাজাহানপুর ও গাবতলীতে সব অবৈধ ইটভাটায় তাঁর অর্ধেক শেয়ার, শত একরের ওপর ধানি জমি এবং শাজাহানপুরের মাঝিড়াতে বহুতল ভবন রয়েছে।
এমপি হওয়ার পরপরই তিনি ‘নোয়া হাইব্রিড’ মডেলের একটি মাইক্রোবাস কেনেন। গাড়িটি এলাকার অবৈধ ইটভাটা মালিকরা ‘উপঢৌকন’ দেন করে বলে অভিযোগ ওঠে। তবে ঘুষ নয় দাবি করে এমপি বাবলু নিজেই জানান, গাড়িটি তাঁকে এক বন্ধু ভালোবেসে উপহার দিয়েছেন। তবে সেই বন্ধুর নাম-ঠিকানা তিনি প্রকাশ করেননি। শাজাহানপুর উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘শুনেছি, স্থানীয় অবৈধ কিছু ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে তিনি (এমপি) টাকা নিয়ে গাড়ি কিনেছেন। তবে এর সঙ্গে আমরা বৈধ ভাটা মালিকরা জড়িত নই।’
বাটপারি যখন শিল্প
এমপি বাবলু একসময় বগুড়ার আদালত এলাকায় টাইপিস্টের কাজ করতেন। তখন চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে, আদালত থেকে জামিন করিয়ে দেওয়ার কথা বলে তিনি মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতাতেন। শাজাহানপুরের বাসিন্দারা জানান, কিশোর বয়স থেকেই প্রতারণার হাতেখড়ি বাবলুর। ছাত্রজীবনে স্থানীয় গোয়াইল এলাকায় এক বাড়িতে গৃহশিক্ষক থাকার সময় জাল টাকার কারবার করতেন। ওই সময় যন্ত্রপাতিসহ হাতেনাতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এ ছাড়া নির্বাচনী হলফনামায় প্রতারণার মামলা থাকার তথ্যও গোপন করেন তিনি। মামলাটির অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে।
২০০৭ সালের এ মামলার বাদী শাজাহানপুরের গোয়ালগাছা গ্রামের আবু হায়াত। মামলায় উল্লেখ করা হয়, শওকত আলী গুলবাগীই বর্তমান এমপি রেজাউল করিম বাবলু। আবু হায়াতের কাছ থেকে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা নেন গুলবাগী। কিন্তু তাঁকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। টাকা ফেরতও দেননি। এ ব্যাপারে আদালতে ৪০৬/৪২০ ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। অভিযোগপত্রে গুলবাগী ওরফে বাবলুকে একমাত্র আসামি হিসেবে পলাতক দেখানো হয়। আবু হায়াত বলেন, আদালতে মামলাটি এখনও চলছে।
দুদকের তৎপরতা
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ায় দুদক বগুড়া সমন্বিত কার্যালয় থেকে এমপি বাবলুকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তদন্তে অনেক অবৈধ সম্পদের খোঁজ পাওয়ায় তদন্তকারী কর্মকর্তা তাঁর বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নেন। পরে সেই কর্মকর্তা বদলি হওয়ার পর এমপি বাবলু মামলার কার্যক্রম চাপা দিয়ে রাখতে নানা তৎপরতা শুরু করেন।
দুদক বগুড়া সমন্বিত কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, বাবলু নির্বাচনী হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী জমা দিয়েছিলেন, এর চেয়ে এখন শতগুণ বেশি সম্পদ অর্জন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বগুড়ায় নির্মাণাধীন একাধিক বহুতল বাড়ি, ঢাকায় ফ্ল্যাট, ব্যক্তিগত তিন-চারটি গাড়ি কেনার তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে শুল্কমুক্ত একটি বিলাসবহুল ল্যান্ডক্রুজার গাড়িও রয়েছে। শুল্কমুক্ত কোটাতে হলেও খোলাবাজারে এ গাড়ির দাম ১০ কোটি টাকার ওপরে। নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে এমপি বাবলু ২০২১ সালের ২৩ জুন তাঁর সম্পদ বিবরণী জমা দেন।
দুদকের সাবেক সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম জানান, তিনি তদন্তকালে এমপি বাবলুর স্ত্রীর নামে কোটি টাকার বেশি ও এমপির নামে ৬০-৭০ লাখ টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পেয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কথা। এতদিন কেন মামলা হয়নি, তা বোধগম্য নয়। প্রতিষ্ঠানের বর্তমান উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম জানান, এমপি বাবলু তাঁর সম্পদ বিবরণী জমা দিয়েছেন, যা বর্তমানে অনুসন্ধানে রয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আর কোনো তথ্য তিনি দেননি।
যা বললেন এমপি বাবলু
নানা অভিযোগের বিষয়ে রেজাউল করিম বাবলু বলেন, ‘এসব কোনোটাই সঠিক তথ্য নয়। আমি টাকা নিয়ে প্রকল্প দেওয়ার কাজ করি না। আমার অনেক শত্রু। তারা ভালো কাজে ক্ষুব্ধ হয়ে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যারা পথে নেমেছে, তারা অনেকেই মাদকসেবী। আমার চার জামাতা অনেক ধনী। তারা নির্বাচনের সময় আমাকে সহযোগিতা করেছে। এ বাড়িগুলোও তাদের নিজেদের টাকায় হয়েছে।’