ওরা আমার মেয়ের জীবন বিষিয়ে তুলেছিল
সাক্ষাৎকারে জবি শিক্ষার্থী অবন্তিকার মা

জবি শিক্ষার্থী অবন্তিকা
কামাল উদ্দিন
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৪ | ০০:৩৪ | আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৪ | ১০:৫১
গত ১৪ মার্চ আত্মহত্যা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে সহপাঠী রায়হান আম্মান সিদ্দিক ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লিখেছেন তিনি। পরে এ ঘটনায় দ্বীন ইসলাম ও আম্মানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম বলেছেন, ‘ওরা আমার মেয়ের জীবন বিষিয়ে তুলেছিল।’ গতকাল বৃহস্পতিবার সমমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কুমিল্লা প্রতিনিধি কামাল উদ্দিন।
সমকাল: আম্মানের সঙ্গে ঝামেলা শুরু কবে?
শবনম: ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে জবিতে ভর্তির পরপরই আম্মান ও তার চক্রের ১০-১২ জনের টার্গেট হয় অবন্তিকা। ক্লাসে প্রথম হওয়া এর অন্যতম কারণ। নানাভাবে তাকে উত্ত্যক্ত করত। মেয়েকে বলতাম– একটু সহ্য করো, ঠিক হয়ে যাবে। প্রথমবর্ষে থাকতেই বিমানবাহিনীতে ওর চাকরি হয়। এক বছর পর জবিতে ফিরে এলে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়।
সমকাল: অবন্তিকা হোস্টেল ছেড়ে কেন ভাড়া বাসায় উঠলেন?
শনবম: হোস্টেলে আম্মানের সহযোগী কয়েক মেয়ে অবন্তিকাকে পড়তে দিত না। কাপড়চোপড় ডাস্টবিনে ফেলে দিত। বিছানায় চিনি ঢেলে রাখত। পরীক্ষার আগে বই সরিয়ে নিত। রুমে ডিজে পার্টি করত। এক পরীক্ষার আগে রাত ১১টায় ওর মামা হোস্টেল থেকে ওকে বাসায় নিয়ে যায়।
সমকাল : অবন্তিকার বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল...
শবনম: সেটি ছিল আম্মান চক্রের সাজানো নাটক। জিডিতে কী ছিল ওরা জানতে দেয়নি। আম্মানের অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় তারা অবন্তিকাকে ফাঁসাতে জিডি করে। ওর বাবাকে নিয়ে ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট সহকারী প্রক্টরের সঙ্গে বসি। কিন্তু আমাদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। অবন্তিকা কথা বললে ওর একাডেমিক বছর ৬ মাস পিছিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। অনেকটা বাধ্য করে ওর বাবার কাছে অঙ্গীকারনামা নেওয়া হয়।
সমকাল: অবন্তিকার মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করেন?
শবনম: আম্মানসহ ৮-১০ জন সবসময় ওর পিছে লেগে থাকত, অবন্তিকা প্রায়ই সে কথা বলত। এই চক্রে আছে রাগিব হাসান রাফি, রেজাউল, লাকি আক্তার, বন্যা, আঁখি, রিমি, সামিরা, গীতা মণ্ডল, মহিম ও সুমাইয়া।
এ ছাড়া আইন বিভাগের চেয়ারম্যান, প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টর কেউই এ মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না।
সমকাল: আম্মান ফুসবুকে লিখেছেন, অবন্তিকা বাবার শোকে আত্মহত্যা করেছেন...
শবনম: এসব মিথ্যাচার। কারণ অবন্তিকার বাবা মারা গেছেন গত বছরের ১২ এপ্রিল। প্রায় এক বছর পর সে বাবার শোকে মারা যাবে কেন? কেউ কি শখ করে আত্মহত্যা করে?
সমকাল: অবন্তিকা তো প্রশাসনকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন...
শবনম: প্রক্টর অফিসের সব নিয়ন্ত্রণ করত আম্মান। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আমার মেয়েটাকে জীবন দিতে হতো না।
সমকাল: আম্মানের দাপটের নেপথ্যে তাহলে কী?
শবনম: রাজনৈতিক প্রশ্রয় ছাড়া কেউ এমন হতে পারে না। সে (আম্মান) নিজেকে কখনও কখনও সাংবাদিক পরিচয় দিত। পুলিশও নাকি তার কথা শুনত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন জানি তার কাছে জিম্মি ছিল।
সমকাল: গ্রেপ্তার দ্বীন ইসলাম পুলিশকে বলেছেন, তাঁর কোনো দায় নেই...
শবনম: আমার মেয়ে তো বিচার না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আর মৃত্যুর আগে কেউ কারও নামে মিথ্যা লিখে যায় না। শুধু আম্মান আর দ্বীন ইসলাম তো নয়, আরও ৮-১০ জন অবন্তিকাকে জ্বালাত। ওরা আমার মেয়ের জীবন বিষিয়ে তুলেছিল। তারা কি দায় এড়াতে পারে? তদন্ত কমিটিকে সবার নাম বলব।
সমকাল: বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কাকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন?
শবনম: বিভাগীয় চেয়ারম্যান, প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টর সবাই জানতেন। যখনই ঢাকায় গেছি, তখনই তাদের সহায়তা চেয়েছি। শুধু ভিসির রুমে যাওয়া হয়নি। কেউ কথা রাখেনি।
সমকাল: অবন্তিকার সঙ্গে আপনার শেষ কথা কী?
শবনম: ইফতারের আগে ওর মন খারাপ দেখে জানতে চাই– কী হয়েছে? উত্তরে বলে– মা, ওরা মনে হয় আমাকে বাঁচতে দেবে না। সারাক্ষণ পিছে লেগে থাকে। বাসায় এসেও শান্তি পাই না। আম্মান নাকি প্রতিশোধ নেবে। আমি মরে না যাওয়া পর্যন্ত ওরা শান্তি পাবে না।
সমকাল: বিচার পাওয়ার বিষয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
শবনম: শিক্ষার্থীরা তো আন্দোলন করে যাচ্ছে। উপাচার্যকেও আন্তরিক দেখছি। ভয় হয়, যদি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বা সাক্ষী না পাওয়ায় বিচারটা থমকে যায়!
সমকাল: বিশ্ববিদ্যালয়ে শোকসভায় আমন্ত্রণ জানানোর পরও গেলেন না?
শবনম: শুনেছি শোকসভায় অবন্তিকার গুণের প্রশংসা হয়েছে, তাকে মেধাবী বলা হয়েছে। কী লাভ এখন এসব শুনে! জীবিত থাকতে তো মেয়েটা বিচার পেলে না! তাই যাইনি।
সমকাল: সরকারের কাছে কোনো প্রত্যাশা?
শবনম: অবন্তিকার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জেনেছি। উপাচার্যও বিচারের পক্ষে। দু’জন গ্রেপ্তার হয়েছে। আমার মেয়ে তো আর ফিরবে না। দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো মেয়ে যেন আর এমন নিপীড়নের শিকার না হয়। অনেকে প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। তাই অবন্তিকার ঘটনার বিচার হলে সেটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এটাই চাওয়া।