খোকন রাজাকার পলাতক প্রকাশ্যে তার দাদন ব্যবসা
টাকা ফেরত নিতে মারধর হুমকি– বাদ নেই কিছু

রাজাকার খোকন
মনিরুল হায়দার ইকবাল, মোংলা (বাগেরহাট)
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৪ | ২২:২৩
বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরাই পেশা ইব্রাহিম হোসেনের। তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার চাকলা গ্রামে। দুবলার চরে অস্থায়ী বসত গড়েন মাছ ধরার জন্য। এ জন্য স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে দাদনে টাকা নিতে হয়। চলতি মৌসুমের শুরুতে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দাদন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ইব্রাহিম। দেড় লাখ টাকা পরিশোধের পর বাকি টাকার জন্য ১৫ মার্চ দিনভর নির্যাতনের পর ছাড়া হয় তাঁকে। আটক করে রাখা হয় মাছ ধরার ট্রলার। পরে মৌসুমের শেষে ট্রলার বিক্রি করে ঋণ শোধের শর্তে ট্রলারটি ২১ মার্চ ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইব্রাহিম দাদন নিয়েছেন খুলনার যুদ্ধাপরাধ মামলার আলোচিত আসামি খান শফিউল্লাহ খোকনের কাছ থেকে। তিনি ‘রাজাকার খোকন’ হিসেবে পরিচিত। খোকন খুলনার রূপসা উপজেলার আইচগাতি ইউনিয়নের দেয়ারা গ্রামের মৃত শহিদুল্লাহ খানের ছেলে। বর্তমানে তিনি খুলনা মহানগরীর সামসুর রহমান সড়কের বাসিন্দা। তবে গত ফেব্রুয়ারি থেকে আত্মগোপনে আছেন।
খোকনের দাদন কারবার দেখাশোনা করেন তাঁর ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) রূপসার ঘাটভোগ ইউনিয়নের আলাইপুর গ্রামের বাসিন্দা কুতুব উদ্দিন। ইব্রাহিমকে তারা যেদিন দুবলার চরে আটকে রাখেন, সেদিন রোজা রেখেছিলেন ইব্রাহিম। তাঁর অভিযোগ, এদিন তাঁকে নামাজ পড়ারও সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরে বিকেলে মাছ ধরার সরঞ্জামসহ ট্রলার আটকে রেখে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের মধ্যস্থতায় ২১ মার্চ ইব্রাহিমের ট্রলারটি ছেড়ে দেয় কুতুবের লোকজন। তবে ৭ এপ্রিল চলতি মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই ট্রলারটি বিক্রি করে দাদনের টাকা পরিশোধের শর্ত দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে বন বিভাগ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে অভিযোগ করেননি ইব্রাহিম। এ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এতে উল্টো হয়রানির শিকার হতে পারেন– এ ভয় করছেন। ইব্রাহিমের ভাষ্য, কুতুব ও তাঁর দলবল খুবই প্রভাবশালী। তারা পারে না এমন কাজ নেই। তাই দাদন শোধের জন্য তাঁকে শেষ পর্যন্ত ট্রলার বিক্রি করতে হবে।
আরও কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় সমকালের। নিরাপত্তা বিবেচনায় নাম প্রকাশে রাজি হননি তারা। ওই জেলেদের ভাষ্য, কুতুব ও তাঁর লোকজন দাদনের টাকা আদায়ে সবাইকে ভয়ভীতি দেখায়। হুমকি-ধমকি, মারধর– কিছুই বাদ যায় না। মৌসুম শেষের আগে যেভাবেই হোক টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।
সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগ সূত্র জানায়, এবারের শুঁটকি মৌসুমে দুবলার চরে প্রায় ১০ হাজার জেলে সমবেত হয়েছেন। সেখান থেকে প্রায় দেড় হাজার ট্রলার মাছ ধরতে যায় গভীর সাগরে। আহরিত কাঁচা মাছ বিক্রির পাশাপাশি বাছাই করে শুঁটকিও তৈরি করছেন তারা।
২০২৩ সালের ৩ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া মৌসুম চলবে আগামী ৭ এপ্রিল পর্যন্ত। এ মৌসুমে দুবলার চরে জেলেদের থাকা ও শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য ১ হাজার ১০৮টি জেলে ঘর ও ৭৮টি ডিপো স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে বন বিভাগ। আগের মৌসুমে এখান থেকে বন বিভাগের রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৬ কোটি টাকা। এবার লক্ষ্যমাত্রা ৭ কোটি টাকা।
কয়েকজন মহাজনের কাছ থেকে জানা গেছে, তারা জেলের কাছ থেকে সরাসরি সুদ নেন না। শর্ত থাকে, দাদন নেওয়া জেলেরা আহরণ করা সব মাছ ও তৈরি করা শুঁটকি ওই মহাজনের মাধ্যমেই বিক্রি করবে। কেউ তা না করে লোকালয়ে বিক্রি করতে চাইলেও মহাজনের নৌযান ব্যবহার করতে হবে। যদি নির্দিষ্ট মৌসুমে টাকা শোধ করতে না পারেন, একইভাবে তা পরের মৌসুমে শোধ করতে হবে।
জেলেরা বলেন, দাদন নেওয়ার পর তাদের মাছ ও শুঁটকি বিক্রি করতে হয় মহাজনের নির্ধারিত দরে। অথচ, বাইরে বিক্রি করলে তারা বেশি দাম পান। এভাবে কম দরে মাছ-শুঁটকি পেয়ে বিপুল টাকা লাভ করেন দাদন ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে কুতুব উদ্দিনের মোবাইল ফোনে গত কয়েক দিনে চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। শনিবার সকালে তাঁর হিসাব-নিকাশ দেখভালকারী ঝুন্নুনের মোবাইল নম্বরে কল দেওয়া হয়। তিনি কুতুবকে ধরিয়ে দিলেও সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহম্মদের ভাষ্য, জেলেরা নিজেদের প্রয়োজনেই দাদনে টাকা নেন। তবে ওই টাকা আদায়ে আইনের আশ্রয় না নিয়ে জেলে বা ট্রলার আটকে রাখা ঠিক নয়। তাদের জানালে সালিশে মীমাংসার চেষ্টা করেন।
বন বিভাগের দুবলার চর জেলেপল্লি টহল ফাঁড়ির ইনচার্জ ফরেস্ট রেঞ্জার খলিলুর রহমান বলেন, দাদনের টাকা আদান-প্রদান জেলে ও মহাজনদের ব্যাপার। তবে এ নিয়ে অঘটনের তথ্য পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।
যেভাবে উত্থান দুবলার চরে খান শফিউল্লাহ খোকন শেকড় পোঁতেন ১৯৮৪ সালের দিকে। তখন মুক্তিযুদ্ধের সাব কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়া উদ্দিনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। সেখানে মাছ-শুঁটকির কারবার শুরু করেন। দাদনের নামে জেলেদের ঠকিয়ে কয়েকশ কোটি টাকার মালিক বনে যান। সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলনা শহরে তাঁর দুটি বাড়ি রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বিপুল পরিমাণ জমি। নামে-বেনামে টাকা রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রে জানা গেছে, ১০০ কোটি টাকার মালিক খোকন।
দুবলার চরের নিরীহ জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীদের ভয় দেখাতে ২০০২ সালে খোকন ভাড়া করে নিয়ে যান ওই সময়ের কুখ্যাত অপরাধী এরশাদ শিকদার ও লিটুকে। পরের মৌসুমে জেলেদের ওপর হামলা করে মেহের আলীর চরে মাছের ব্যবসা দখলে নেন খোকন। পরে দখলে নেন চর আলোর কোল।
২০১৭ সালে মারা যান দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর জিয়া উদ্দিন। এর পর পুরো ফিশারম্যান গ্রুপ ও দুবলার চর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন খোকন।
কে এই খোকন রাজাকার?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রজীবনে খোকন ছিলেন পাকিস্তানের ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্টের (এনএসএফ) নেতা। ১৯৬৮-৬৯ সালে খুলনার মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুরের লাঠিয়াল বাহিনীতে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনায় খান আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। পরে রূপসা থানার দেয়ারা এলাকায় রাজাকার বাহিনীর সভাপতি হন। খোকন রাজাকারের দলে ২৫-৩০ জন সশস্ত্র সদস্য ছিল। ওই সময় স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান ওরফে শ্যাম মল্লিককে গুলি করে হত্যা করে তার বাহিনী। আরও দুটি হত্যাকাণ্ডে তারা জড়িত ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দলবলসহ পালিয়ে ভারত যান খোকন।
২০২২ সালে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাবা হত্যার ঘটনায় মামলা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান ওরফে শ্যাম মল্লিকের ছেলে সাইফুল মল্লিক গামা। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি তদন্ত দল রূপসায় এসে সাক্ষ্য নেয়। এ সংবাদে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আত্মগোপনে চলে যান খান শফিউল্লাহ খোকন।
- বিষয় :
- দাদন