নিয়তি রানীর এ কেমন ‘নিয়তি’

নিয়তি রানী
ত্রিশাল (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪ | ০০:০৭
একাত্তরে নিয়তি রানীর জীবনে রচিত হয়েছিল এক ভয়ংকর কালো অধ্যায়। পাকিস্তানি হানাদার ক্যাম্পে তাঁকে অনেক দিন আটকে রাখা হয়। হানাদার ও রাজাকারদের অমানবিক নির্যাতনের ঝড় বয়ে যায় তাঁর ওপর দিয়ে। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও মেলেনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি। বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে তাঁর নাম ‘ক’ তালিকায় স্থান পাওয়া সত্ত্বেও গেজেটভুক্ত হয়নি।
নিয়তি রানী (৭১) ত্রিশাল উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের সাউথকান্দা গ্রামের মৃত রাশ বিহারী মণ্ডলের মেয়ে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী এই নারী মৃত্যুর আগে জেনে যেতে পারবেন কি তাঁর সম্ভ্রম হারানোর মূল্য সরকার দিল কিনা? এমন প্রশ্ন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। ত্রিশাল উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের সাউথকান্দা গ্রাম থেকে রাশ বিহারী মণ্ডলের বাড়িতে প্রবেশ করে রাজাকাররা। রাশ বিহারী মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী অর কুমারী দাসের ওপর অমানবিক নির্যাতন শেষে তাদের ১৮ বছর বয়সী মেয়ে নিয়তি রানীকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকাররা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মনোরঞ্জনের জন্য তাঁকে ২০-২৫ দিন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। এ সময় তাঁর ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায় হানাদার ও রাজাকাররা। এরই মধ্যে রসুলপুরের আমরীতলা মোড়ের ওই ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় ময়মনসিংহ দক্ষিণ ঢাকার উত্তরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর আফসার উদ্দিন আহমদের ছোট ভাই ইসমাঈল হোসেনকে। এমন খবরে ওই ক্যাম্পে আক্রমণ চালায় মেজর আফসার বাহিনী। সেখান থেকে ইসমাঈল হোসেনকে বাঁচানোর পাশাপাশি উদ্ধার করা হয় নিয়তি রানীকে। স্বাধীনতার পর নিয়তি রানীকে বীরাঙ্গনা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তবে ভবিষ্যতের কথা ভেবে জীবনের কলঙ্কিত অধ্যায়টি ধামাচাপা রাখতে তাতে সাড়া দেয়নি তাঁর পরিবার।
অতঃপর একদিন রাশ বিহারী মণ্ডল ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার পল্লী চিকিৎসক ব্রজেন্দ্র চন্দ্র নমদাসের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন। অবশ্য বিয়ের আগেই জামাতাকে সব ঘটনা জানান। ৩০ লাখ শহীদ আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশের পতাকার দিকে তাকিয়ে নিয়তি রানীর বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেন ব্রজেন্দ্র চন্দ্র নমদাস। একটা সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সংসারে অভাব-অনটন দেখা দেয়।
নিরুপায় হয়ে সরকারি সুবিধা পেতে ২০১২ ও ২০১৪ সালে অনলাইনে আবেদন করেন নিয়তি রানী। এতে ২০১৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে ‘ক’ তালিকাভুক্ত হয়ে প্রথমবার বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি পান তিনি। কিন্তু ২০১৭ ও ২০২১ সালের যাচাই-বাছাইয়ে বীরাঙ্গনা গেজেটে নিয়তি রানীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে কড়া নাড়লেও মিলছে না স্বীকৃতি।
নিয়তির স্বামী ২০১৬ সালে পরলোক গমন করেন। আর তিনি নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। মায়ের ওষুধ আর দু’বেলা, দু’মুঠো খাবারের জোগান দিতে হিমশিম খান মেয়ে অর্চনা রানী সরকার ও ছেলে বুদন চন্দ্র দাস।
নিয়তি রানী সমকালকে বলেন, ‘অনেক প্রত্যয়ন পেলেও বীরাঙ্গনা গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আশায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিয়েছি। আমার জীবনের ভয়ংকর সেই দিনগুলো যেন তাদের হৃদয়ে
নাড়া দেয় না।’ গত শনিবার রাতে ঝড়ে তার ঘরের একটি চালা উড়ে গেছে বলে জানান তার মেয়ে অর্চনা রানী সরকার।
ত্রিশাল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল হেকিম জানান, নিয়তি রানীর নাম মুক্তিযোদ্ধার গেজেটভুক্ত না হওয়াটা দুঃখজনক।
- বিষয় :
- পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী