রাউজানে বাজে না ভোটের বাজনা

.
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ০১:০২ | আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১৪:২২
প্রচলিত নিয়মে নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে ভোটের তপশিল হয়। এর পর ইসিকে ‘দর্শক’ বানিয়ে সবকিছুই চলে যায় স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে। তিনিই হয়ে যান অঘোষিত নির্বাচন কমিশনার! ফলে চট্টগ্রামের রাউজানে আর বাজে না ভোটের দামামা। ছাপাখানায় ছাপাতে হয় না পোস্টার-লিফলেট; হয় না মাইকিং, থাকে না প্রচারণা। আট বছর ধরে রাউজানের স্থানীয় সরকার তথা উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ঘিরে চলছে বিনা ভোটের এমন তামাশা। যেন ভোট ছাড়া জনপ্রতিনিধির জন্য অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে রাউজান। স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনেই পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পেরে নাখোশ ওই উপজেলার অন্তত তিন লাখ ভোটার।
এ উপজেলার স্থানীয় নির্বাচনে বিরোধী দলের কোনো প্রার্থী তো বটেই, সরকারদলীয় একের বেশি নেতার ভোটে দাঁড়ানোর সাহস নেই। স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচনের আগে এ উপজেলাতে হয় সমঝোতা বৈঠক। সেই বৈঠকে যে প্রার্থীকে চূড়ান্ত করা হয়, তিনিই বনে যান বিনা ভোটের জনপ্রতিনিধি। ভোটের এমন ফর্মুলার ‘আবিষ্কারক’ স্থানীয় এমপি ফজলে করিম চৌধুরী। তাঁর কথার বাইরে গিয়ে এ উপজেলায় ভোট করার সুযোগ ও সাহস কারও নেই।
এবারও রাউজান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। প্রতিটি পদে এবারও একজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন রাউজান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা রকর চাকমা। গতবারের মতো এবারও বিনা ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান হচ্ছেন এ কে এম এহেছানুল হায়দর চৌধুরী বাবুল। তবে ২০০৯ ও ২০১৪ সালে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। এবারসহ টানা চারবার চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছেন বাবুল।
‘এমপিই নির্বাচন কমিশনার’
রাউজানে বেসরকারি এক ব্যাংকে চাকরি করেন আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘রাউজানে এমপির কথাই আইন। এমপিই এখানে নির্বাচন কমিশনার। উনার কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই কারোর। তাই আগ্রহ থাকলেও যোগ্য প্রার্থীরা উনার মতের বাইরে গিয়ে ভোট করেন না।’
পৌর এলাকার বাসিন্দা মুহাইমিনুল ইসলাম বলেন, ‘পৌর নির্বাচনে মেয়র হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। উপজেলা নির্বাচনেও টানা দুই টার্ম কোনো ভোট হচ্ছে না। এমপি নির্বাচনে এবার ভোট হলেও সেখানে ছিল ডামি প্রার্থী। তাই ভোট কী জিনিস, তা ভুলতে বসেছে রাউজানবাসী।’
যেভাবে হচ্ছে ভোট
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন আওয়ামী লীগের এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। সেই থেকে রাউজানে বিনা ভোটের রেওয়াজ শুরু। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে ১৪ ইউনিয়নের মধ্যে ১১টিতেই ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি ভোটাররা। সেবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি হন ১২২ জন। তবে নোয়াপাড়া, বিনাজুরী ও কদলপুর ইউনিয়নে ভোট হয়েছিল। কদলপুর ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী ছিলেন মোজাহেদ চৌধুরী লিংকন এবং বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা তছলিম উদ্দিন। স্থানীয় এমপি তখন ঝুঁকেছিলেন বিদ্রোহী প্রার্থীর দিকে। প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে নৌকার প্রার্থী লিংকন ভোটের দিন সরে দাঁড়ান। এ ব্যাপারে মোজাহেদ চৌধুরী লিংকন বলেন, নৌকার বিপক্ষে গিয়ে তখন স্থানীয় এমপি আমাকে পরাজিত করেছেন। আমি এখনও এলাকাছাড়া।
এরপর ২০২১ সালে উপজেলার ১৪ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ১৪ জন, মেম্বার পদে ১২৬ জন ও সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডে ৪২ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন। সেবার প্রতিটি পদে একজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় ১৮২ জন একযোগে বিনা ভোটে জেতেন। ২০২১ সালের পৌর নির্বাচনেও বিনা ভোটে জেতেন মেয়র ও সাধারণ ওয়ার্ডের ১২ এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের তিন কাউন্সিলর। ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী চেয়ারম্যান পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এবারও তিন প্রার্থী একই পথের পথিক। অবশ্য গেল ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ভোট হয়েছে রাউজানে। তবে সেটিও ছিল ‘ডামি’ ভোট; যাতে নৌকার প্রার্থী ফজলে করিম ২ লাখ ২১ হাজার ৫৭২ ভোট পেয়ে জয়ী হন। আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী চার প্রার্থী সবাই মিলে পেয়েছেন ৭ হাজার ৮৯৯ ভোট!
বিনা ভোটের অভিজ্ঞতা আছে এমপিরও
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রাউজান থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। ওই নির্বাচনে তাঁর মতো সারাদেশে আরও ১৫২ জন বিনা ভোটে এমপি হয়েছিলেন। তবে ২০১৮ সালে নির্বাচন করে এমপি হয়েছেন ফজলে করিম। ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনেও ছিল তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে তারা কেউই ছিলেন না শক্ত প্রতিপক্ষ। এলাকার বাসিন্দারাই তাদের ‘ডামি প্রার্থী’ মনে করেন। সর্বশেষ এ নির্বাচনে ফজলে করিম দুই লক্ষাধিক ভোট পেলেও তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিউল আজম পান মাত্র ৩ হাজার ১৫৯ ভোট।
কারা কী বলছেন
সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘এক উপজেলাতে আট বছর ধরে স্থানীয় সরকারের কোনো ভোট না হওয়া প্রহসন ছাড়া আর কিছু না। জনগণ তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে না পারলেও জনপ্রতিনিধি হচ্ছে এমপির পছন্দের মানুষ। এটি নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি তৈরি করছে চরম অনাস্থা। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও হয়েছে এ প্রহসন। সেখানে একাধিক প্রার্থী থাকলেও তারা ছিল মূলত ডামি। ভোটের ব্যবধান পর্যালোচনা করলে প্রমাণ হবে এই সত্য। রাউজানে কেন কেউ স্বনামে বক্তব্য দিতে চায় না, কারণ লুকিয়ে আছে সেখানেও।’
এবার বিনা ভোটে নির্বাচিত হতে যাওয়া উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী এহেছানুল হায়দর বাবুল বলেন, ‘এখন নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দিতে হয় অনলাইনে। যে কারও ভোট করার অধিকার রয়েছে। এখানে বলপ্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। রাউজানের অভিভাবক এমপি সাহেব। উনার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান করা থেকে কেউ মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি।’
রাউজানের পৌর মেয়র জমির উদ্দিন পারভেজ বলেন, ‘এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী রাউজানের মুরব্বি। তিনি নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রভাব বিস্তার করেন না। তবে প্রয়োজন হলে উনার পরামর্শ নিই আমরা।’
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের নেতা ফজলে করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে রাউজানবাসী ঐক্যবদ্ধ। দলে যারা নিবেদিত ও ত্যাগী, তাদের তিনি মূল্যায়ন করেন। উনার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখে উনি যাদের মনোনীত করেন, তাদের প্রতি সবস্তরের সমর্থন জানিয়ে কেউ প্রার্থী হয় না। আবার তিনি কাউকে নির্বাচন করতে বাধাও দেন না।’
এ ব্যাপারে স্থানীয় এমপি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী সমকালের সঙ্গে কথা বললেও সার্বিক বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
- বিষয় :
- নির্বাচন
- রাউজান
- ভোট
- উপজেলা নির্বাচন