ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

ব্যাঙের ছাতার মতো ক্লিনিক চিকিৎসার নামে প্রতারণা

ব্যাঙের ছাতার মতো ক্লিনিক চিকিৎসার নামে প্রতারণা

বাকৃবিতে নির্বিচারে গাছপালা কেটে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রতিবাদে শুক্রবার মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা সমকাল

খলিলুর রহমান শেখ, নেত্রকোনা

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৪ | ০০:২৯

নেত্রকোনায় যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিক। এসব প্রতিষ্ঠানে মানা হচ্ছে না সরকারি নিয়মনীতি। চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন রোগীরা। অপচিকিৎসায় বিপন্ন জীবনমান।

নেত্রকোনা সিভিল সার্জন অফিসের নাকের ডগায় গড়ে উঠেছে অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি, ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতাল। জেলা শহরেই ৮৪টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিক রয়েছে। এর অধিকাংশই অনুমোদনহীন। আবার উপজেলাগুলোতে থাকা বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নেই। চিকিৎসাসেবার নামে দেদার চলছে এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ব্যবস্থা নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট দপ্তর। অপচিকিৎসার কথা স্বীকার করে সিভিল সার্জন বলেন, তিনি ওই সব অনুমোদনহীন ক্লিনিক বন্ধ করতে চান; কিন্তু পারছেন না।

সিভিল সার্জন অফিস ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নেত্রকোনা জেলায় ১৭৯টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি, ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে ৩১টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন করা। ২৬টি নবায়নের জন্য আবেদন করেছে। বাকি ১২২টির লাইসেন্স করা হলেও নিয়মের বেড়াজালে হয়নি নবায়ন। তার পরও চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম।
নেত্রকোনা জেলা শহরে ৫৯টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ২৫টি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। অন্য ৯ উপজেলায় ৯১টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি, ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রথমে খাজনা রসিদ, ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর রিটার্ন, ফায়ার সার্ভিস, কলকারখানা, ভ্যাট ও অনাপত্তিপত্র নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করতে হয়। পরিবেশের আবেদনের ‘মানি রিসিপ্টের কপি’ নিয়ে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করতে হয়। এই মূলে প্রথমে লাইসেন্স দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে পরে পরিবেশ অধিদপ্তর যাচাই-বাছাই করে অনেক প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেয় না। ছাড়পত্র না পাওয়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নবায়ন করতে গেলে আর নবায়ন হয় না।
সম্প্রতি জেলা শহরের মুন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মোক্তারপাড়া এনাম হাসপাতাল, প্রাইম হাসপাতাল, কেন্দুয়া উপজেলার সাদিয়া, নিউ পপুলার, বারহাট্টা মাইল্যাব, পদ্মা, কলমাকান্দা মা, সুমেশ্বরী, আটপাড়া ফয়সাল, মদনে তাপস, মোহনগঞ্জে রাজন, আদর্শ ল্যাব, দুর্গাপুরে সুসং, মা, ইসলামিয়া, পূর্বধলা ফাতেমা, মর্ডান ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘুরে দেখা গেছে, এক সময় লাইসেন্স নেওয়া থাকলেও পরে আর নবায়ন করা হয়নি। তার পরও দেদার চলছে ব্যবসা।

ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি, ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্যাথলজিস্ট, সনোলজিস্ট ও রেডিওগ্রাফার পদে জনবল থাকা আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে নিয়োগ দেখালেও বাস্তবিক অর্থে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই সব ধরনের জনবল নেই। তবুও চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। 
বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও তিন শিফটে ডিপ্লোমা সনদধারী নার্স থাকার কথা। কিন্তু অধিকাংশ হাসপাতালে নার্সের পরিবতে শিক্ষার্থী ও অভিজ্ঞ আয়া দিয়ে চলছে কার্যক্রম। আবাসিক মেডিকেল অফিসারও নেই।
এনাম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা আটপাড়া উপজেলার এক প্রসূতি পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘আমার তিন দিন আগে সিজার হয়েছে। এর পর আর ডাক্তার আসেননি।’
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে নেত্রকোনা শহরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক জানান, উপজেলা শহরের ৭০-৮০ ভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এক্স-রের জন্য সনদধারী রেডিওগ্রাফার নেই। কাজ দেখতে দেখতে অভিজ্ঞ হয়েই এখন এক্স-রে করছেন তারা। এ ছাড়া সঠিকভাবে চলা সম্ভব না।

কথা হয় নেত্রকোনার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মান্নান খান আরজুর সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, দাপ্তরিক অব্যবস্থাপনার কারণে অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। যাদের ছাড়পত্র পাওয়ার যোগ্যতা আছে, পরিবেশ অধিদপ্তর তাদের অনুমোদন দিয়ে অন্যগুলোর আবেদন বাতিল করলে চিকিৎসাসেবার মান ভালো হতো। তিনি বলেন, ‘জেলায় ডাক্তার সংকট, তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান বিপদে আছে। বিশেষ করে জেলায় মাত্র ছয়জন অ্যানেস্থেশিয়ার ডাক্তার রয়েছেন। তাদের ইচ্ছামতো কাজ করতে হয় আমাদের। এ ছাড়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেসব পরীক্ষা করা হয়, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে সরঞ্জামাদিই নেই। আমরা চাই, সংশ্লিষ্ট দপ্তর কার্যকর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে লাইসেন্সের আওতায় অথবা আবেদন বাতিল করে জনসাধারণকে সঠিক চিকিৎসাসেবার মান নিশ্চিত করা হোক।’

নেত্রকোনা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবু সাঈদ জানান, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ পরিবেশ অধিদপ্তরের নীতিমালা অনুযায়ী যাদের সব ঠিক আছে, তাদের ছাড়পত্র দিয়েছেন তিনি। নেত্রকোনায় যোগদানের আগে অনেক আবেদন হয়েছিল, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে কিছু অনুমোদন পেয়েছে, আবার অনেক বাতিল হয়েছে। বিশেষ করে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেখে।
অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে অপচিকিৎসার বিষয়টি স্বীকার করেছেন সিভিল সার্জন ডা. সেলিম মিঞা। তাঁর ভাষ্য, এরই মধ্যে জেলা সদর ও দুর্গাপুরে কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার নানা ত্রুটির কারণে বন্ধ করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, ‘অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাই। কিন্তু অনেক বড় বড় 
রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) আসে, সে জন্য কাজ ঠিকমতো করা যায় না।’

আরও পড়ুন

×