ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সবুজ হারিয়ে ঢাকা হচ্ছে ‘মৃত নগরী’

সবুজ হারিয়ে ঢাকা হচ্ছে ‘মৃত নগরী’

.

 জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৪ | ০০:৩৫

শুক্রবার দুপুর, রাজধানীর মহাখালীর তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঠিক একই সময় ৫ কিলোমিটার দূরত্বের রমনা পার্ক এলাকায় তাপমাত্রা ৩২। এ সময় ঢাকার গড় তাপমাত্রা ৩৮ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তরের এ তথ্যই যথেষ্ট রাজধানীকে সবুজহীন করে বসবাসের জন্য বিষিয়ে তোলার চিত্র। অথচ কয়েক ঘণ্টা আগে বৃহস্পতিবার রাতে নগরী সিক্ত হয় বহুল কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিতে। টানা ৩১ দিন তাপপ্রবাহের পর রাতে ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে স্বস্তির ঘুম দিলেও সকালে আবারও নগরবাসীকে নামতে হয় ‘জ্বলন্ত উনুনে’। তবে ঢাকার যেসব এলাকায় গাছপালাসহ সবুজের সমারোহ, সেখানে গরম কম অনুভূত হয়েছে বলে অনেকে জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্য সব দেশ ও শহর তপ্ত হওয়ার পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব প্রযোজ্য হলেও ঢাকার ক্ষেত্রে এটি একমাত্র কারণ নয়। স্বল্প জায়গায় বিপুলসংখ্যক মানুষের বসতি, মাত্রাতিরিক্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার, জলাভূমি ও গাছপালা সাবাড় করে বেশির ভাগ জায়গা কংক্রিটের স্থাপনা দখল করায়ই বছর বছর বাড়ছে অতি উষ্ণতার ঝুঁকি। রাজধানী শহর এতটাই ‘তপ্ত ভূখণ্ডে’ পরিণত হচ্ছে, বৃষ্টিও তার উত্তাপের রাশ টানতে পারছে না। বর্তমানে ঢাকায় প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা এলাকার সঙ্গে অন্যান্য স্থানের দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য ৩ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গাছ কেটে, জলাশয় ভরাট করে ঢাকাকে বিপদে ফেলার নেতৃত্বে সবচেয়ে এগিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান। এমন পরিস্থিতিতে নগরীর মৃত্যু ঘনিয়ে আসার আগেই সবুজায়ন বৃদ্ধি ও জলাশয় রক্ষার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

গাছ-জলাশয় ধ্বংসে এগিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়নের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে জলাশয়। প্রকল্পের পর প্রকল্প বাস্তবায়নে কাটা পড়ছে বৃক্ষরাজি; উধাও হচ্ছে শীতল ছায়া। গত বছর মে মাসে রাজধানীর ধানমন্ডিতে নগর উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সাত মসজিদ রোডের প্রায় ৩০০ বড় গাছ কাটে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ছাদবাগান উৎসাহে রেখেছে ১০ শতাংশ কর ছাড়। অথচ সরকারি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে বৃক্ষ রক্ষায় উদাসীনতার এন্তার অভিযোগ। মহাখালী থেকে গুলশান ১ নম্বর পর্যন্ত সড়ক, নর্দমা ও ফুটপাত উন্নয়ন কাজে দেয়াল দিয়ে উঁচু করা হয়েছে সড়ক বিভাজক। এজন্য বিভাজকের বিভিন্ন জায়গার গাছ কাটা হয়েছে।
মহাখালী থেকে বনানী সড়কের পাশের সবুজ বেষ্টনীর গাছপালা কেটে করা হয়েছে অস্থায়ী বাজার। সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন, সড়ক ও জনপথের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় করতে গিয়েও কাটা হয়েছে অসংখ্য গাছ। সৌন্দর্যবর্ধনের থাবায় উজাড় হয়েছে বনানীর কাকলী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের দু’পাশের গাছপালা। মেট্রোরেলের জন্য বেগম রোকেয়া সরণি, আগারগাঁও ও শ্যামলী শিশুমেলা এলাকায় কাটা পড়েছে গাছ। বিআরটি প্রকল্পের জন্যও উত্তরায় নিধন হয়েছে বৃক্ষ।

একসময়ের সবুজে ঘেরা রাজধানীর ওসমানী উদ্যানে গত কয়েক বছর ধরে চলা উন্নয়নের কুঠারে হারিয়ে গেছে অসংখ্য গাছ। সেখানে জায়গা গেড়েছে পাকা স্থাপনা। একইভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্কের উন্নয়ন করতেও কাটা হয়েছে গাছ।

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার আনোয়ার পার্কের গাছ কেটে করা হয়েছে মেট্রোরেলের মালপত্র রাখার স্থান। আজিমপুরের সরকারি কলোনিগুলোর ফাঁকে একসময় প্রচুর গাছপালা ছিল। এখন সেখানে মাথা উঁচু করে আছে সুরম্য অট্টালিকা। কল্যাণপুরে সরকারি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণেও কাটা হয়েছে অসংখ্য গাছ।

কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউর ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রাস্তার মাঝে যে ছোট ছোট গাছ ছিল, তা এখন আর নেই। গাছপালায় ভরা কারওয়ান বাজারের পান্থকুঞ্জ পার্ক এখন বিরানভূমি হতে চলেছে। দায়িত্ব পেয়ে বিমানবন্দর থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত রাস্তায় একটি বেসরকারি সংস্থা বিদেশি বনসাই গাছ লাগালেও, এখন তা বিলীন।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, গাছ তাপ শুষে অক্সিজেন ও ঠান্ডা বাতাস ছাড়ে। তাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে জলাশয়ও। অথচ আমরা এ দুটিকে ক্রমাগত মেরে ফেলে শহরকে বসবাসের অযোগ্য বানাচ্ছি। এভাবে চললে ঢাকার মৃত্যুঘণ্টা বাজতে বেশি সময় লাগবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিহির লাল সাহা বলেন, খুব ঝুঁকিপূর্ণ না হলে গাছ কাটা উচিত না। গাছ কাটা অপরাধ, জড়িতদের বিচার হওয়া উচিত। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, একটা সময় রাস্তার পাশে কিছুদূর পরপর বটগাছ থাকত। বটের বিশাল ক্যানোপি ছায়া দিত, তপ্ত দুপুরে ক্লান্ত পথিক বিশ্রাম নিতে পারত। এখন সেসব নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল ইসলামের অভিযোগ, ‘বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরাসরি দায়ী রাষ্ট্রযন্ত্র। এখনও সময় আছে, সবাই মিলে সবুজায়ন ফিরিয়ে আনতে না পারলে ঢাকার অবস্থা হবে ভয়াবহ।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘গাছ কাটা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশে আলাদা আইন আছে। আমাদের দেশেও এ ধরনের আইন করে তার প্রয়োগ জরুরি। আইন করতে দেরি হলে আপাতত সরকারি নির্দেশনার মাধ্যমে গাছ কাটা থামানো দরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার সড়ক দ্বীপগুলোতে প্রচুর গাছ লাগানোর সুযোগ রয়েছে। ফাঁকা পড়ে থাকা পুরোনো বিমানবন্দরের মতো জায়গাগুলো সবুজায়ন করতে হবে। হাজারীবাগে ট্যানারি এলাকায় ড্যাপ অনুযাযী একটি ফরেস্ট বা সবুজায়ন করা জরুরি।’

ঢাকায় দ্রুত বাড়ছে তপ্ত এলাকা
কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে নেওয়া ছবি ও তাপমাত্রা পরিমাপ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগ কত দ্রুত ঢাকার তপ্ত এলাকা বাড়ছে, তা দেখিয়েছে। এতে দেখা যায়, ১৯৮৯ সালে যেখানে ঢাকার ৩০ শতাংশ এলাকা তপ্ত ছিল, ২০১৪ সালে এসে তা হয় ৬৫। গত এপ্রিলে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ৯০ শতাংশ এলাকা তীব্র তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে। এমন হয়েছে প্রাকৃতিক নয়, মানুষের কারণে। যেসব এলাকা এক সময় নিচু ভূমি ও জলাশয় ছিল, দ্রুত সেখানে তোলা হয়েছে নানা অবকাঠামো। রাখা হয়নি জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান ও বৃক্ষরাজি। দিনে যে পরিমাণ সূর্যের আলো আসে, তা ভবনের গায়ে, ছাদে, পার্শ্ববর্তী রাস্তায় জমে থাকে। সূর্য ডোবার পর জমে থাকা তাপ অল্প অল্প করে ছড়ায়। ফলে ঘরে-বাইরে সমান গরম অনুভূত হচ্ছে।
২০২৩ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণায় বলা হয়, ২০১৫ সালে ঢাকা শহরে সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫৩ দশমিক ১১ বর্গকিলোমিটার। ২০২৩ সালে তা কমে হয়েছে ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটার। এপ্রিলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএসের এক সমীক্ষায় বলা হয়, ঢাকা শহরে ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সাল; অর্থাৎ ৩১ বছরে ৫৬ শতাংশ গাছপালা কমেছে। বর্তমানে শহরের মাত্র ২ শতাংশ এলাকায় সমৃদ্ধ ও পরিবেশবান্ধব প্রজাতির গাছপালা এবং লতাগুল্ম টিকে আছে। মোট বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা মাত্র ৮ শতাংশ।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেড ক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর যৌথভাবে ঢাকা শহরের তাপপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এতে ঢাকার ২৫টি স্থানকে ‘তপ্ত দ্বীপ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলোর মধ্যে বাড্ডা, গুলশান, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, গাবতলী, গোড়ান, বাসাব, টঙ্গী, শহীদনগর, বাবুবাজার, পোস্তগোলা, জুরাইন, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কুর্মিটোলা, আজমপুর, উত্তরা, কামারপাড়া, মোহাম্মদিয়া হাউজিং, আদাবর, ফার্মগেট, তেজকুনিপাড়া, নাখালপাড়া ও মহাখালী এলাকা রয়েছে।

 

আরও পড়ুন

×