ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

উত্তরে প্লাবিত নিম্নাঞ্চল, সিলেট বিভাগে উন্নতি

গাইবান্ধা-কুড়িগ্রামের নিম্নাঞ্চলে পানিবন্দি হাজারো মানুষ

উত্তরে প্লাবিত নিম্নাঞ্চল, সিলেট বিভাগে উন্নতি

তিস্তার পানিতে তলিয়ে গেছে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধন এলাকা সমকাল

 সমকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৪ | ০০:৫১ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৪ | ০৭:২৯

টানা বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সিলেটসহ ওই বিভাগের সব জেলায় চলছে বন্যা। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে রোদ ওঠায় গতকাল শুক্রবার সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ। এর মধ্যেই ফুঁসতে শুরু করেছে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়াসহ উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদনদী। ফলে বন্যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোয়।

এরই মধ্যে রংপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের নিম্নাঞ্চল এবং চর এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ১৩১ সেন্টিমিটার ও করতোয়া নদীর পানি চকরহিমাপুর পয়েন্টে ১৮৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। 

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, তিস্তাসহ অন্যান্য নদনদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। নদীভাঙন রোধে সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

এরই মধ্যে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর, কাপাসিয়া, হরিপুর ও বেলকা এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, গ্রামীণ রাস্তা, আমনের বীজতলা, সবজি ক্ষেত ও পশু চারণক্ষেত্র। তিস্তার তীব্র স্রোতে গাইবান্ধা সদর উপজেলার মোল্লারচর ও ফুলছড়ির ফজলুপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। 

কাপাসিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনজু মিয়া বলেন, আমার ইউনিয়নে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবারসহ নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুন্দরগঞ্জ ইউএনও তরিকুল ইসলাম জানান, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। 

জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল বলেন, বন্যার জন্য আগাম প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। দুর্গম অঞ্চলে বন্যাকবলিত মানুষকে উদ্ধারে সরকারি-বেসরকারি নৌকা ও স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রয়েছে। ইউএনওদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকায় শুকনো খাবার সরবরাহ করা হবে। সুন্দরগঞ্জের কাপাসিয়া ও হরিপুরে ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়া পরিবারের মধ্যে ঢেউটিন এবং নগদ অর্থ বিতরণ করা হবে। 

কুড়িগ্রামে ধরলা ও তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়ছে হু হু করে। এরই মধ্যে জেলার সব নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী, উলিপুর, রৌমারী ও সদর উপজেলার ৭০টি চর ডুবে প্রায় ২২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে চার দিন ধরে। তলিয়ে গেছে ৪৫৩ হেক্টর ফসলি জমি। ভাঙনের কারণে যাত্রাপুর ইউনিয়ন ও রাজারহাটের বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের কয়েকটি স্থাপনা ও বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। 

কুড়িগ্রাম পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জানান, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় কুড়িগ্রামের নদনদীর পানি আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। জেলা প্রশাসক সাইদুল আরীফ জানান, বন্যা মোকাবিলায় ১৩ লাখ টাকা, ১৩ টন চাল, ২৫০ বান্ডিল টিন, নৌকা ও আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

লালমনিরহাটেও তিস্তা, ধরলা, সানিয়াজানসহ সব নদনদীর পানি বেড়েছে। প্লাবিত হয়েছে জেলার পাটগ্রামের দহগ্রাম ও ব্যারাজের ভাটিতে থাকা হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী চরাঞ্চল। জেলার চারটি উপজেলার নদীতীরবর্তী ছয়টি ইউনিয়নের প্রায় হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। পানি নিয়ন্ত্রণে হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে অবস্থিত দেশের সর্ব বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইসগেট খুলে দিয়েছে পাউবো। রংপুরেও একই অবস্থা বন্যার। 

এদিকে সিলেটে ধীরে ধীরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। কমতে শুরু করেছে নদী ও হাওরের পানি। তার পরও গতকাল পর্যন্ত জেলায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন প্রায় ২৭ হাজার মানুষ। গতকাল সিলেট নগরীর ক্বিন ব্রিজ এলাকায় সুরমা নদী পরিদর্শন করেছেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। তিনি বলেছেন, সিলেটবাসীকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। 

বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের মধ্যে গতকাল ত্রাণ সহায়তা প্রদান করেছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। গতকাল সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি সরেজমিন পরিদর্শন করে ত্রাণ বিতরণ করেন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম ইউ কবীর চৌধুরী। 

জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানান, ১৩ উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৯ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। তবে শুক্রবার কিছু মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, সদর ও বিশ্বনাথ উপজেলায় ২ হাজার মানুষের মধ্যে রান্না করা ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

কুশিয়ারা নদীর মৌলভীবাজার অংশের শেরপুর পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলার নদীতীরবর্তী প্লাবিত এলাকার মানুষের দুর্ভোগ কমছে না। সীমান্তঘেঁষা জুড়ী নদীর পানিও বিপৎসীমার ১৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত অব্যাহত থাকায় জুড়ী, বড়লেখা ও হাকালুকিপাড়ের জনপদের মানুষের দুর্দশা চরম আকার ধারণে করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ হাজার ১০০ হেক্টর জমির ফসল। কুলাউড়া-সিলেট রেললাইনের কিছু অংশ পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন। 

সুনামগঞ্জেও বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে পানি ধীরে কমায় দুর্ভোগ কমেনি। জেলা শহরের পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ নতুনপাড়ায় এখনও হাঁটুপানি। শান্তিবাগ, হাছননগরের কিছু অংশ, কালীপুর, ওয়েজখালীর কিছু অংশ, তেঘরিয়ার কিছু অংশ, পশ্চিম হাজীপাড়া, মল্লিকপুর ও নবীনগরে কিছু এলাকায় নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমার পানি বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আগামী পাঁচ থেকে সাত দিন আবহাওয়া ভালো থাকবে। হালকা থেকে মাঝারি ছাড়া বড় ধরনের কোনো বৃষ্টির আশঙ্কা নেই।

সিলেট ও কলমাকান্দায় ২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু 
নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের রাতকান্দা গ্রামে ঢলের পানিতে ভেসে গিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী রিফাত হোসেন (১১) মারা গেছে। গতকাল দুপুরের দিকে বাড়ির সামনের রাস্তায় ঢলের পানির তোড়ে ভেসে যায় রিফাত। সে রাতকান্দা গ্রামের আবু কালামের ছেলে। 

একই দিন দুপুরে সিলেট নগরীর শাহপরাণ থানা এলাকায় বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে সাইদুর রহমান অভি নামে এক স্কুলছাত্র। নগরীর ৩১ ওয়ার্ডের মুক্তিরচক জামে মসজিদের পাশে একটি খালে বন্যার পানিতে গোসল করতে গেলে অভি তলিয়ে যায়। অভি সেনাসদস্য ওমর ফারুকের ছেলে। 
 [তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যুরো, অফিস, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতারা]


 

আরও পড়ুন

×