যদুবয়রা ইউনিয়ন পরিষদ
পরিষদে পরিষদে সুনসান নীরবতা

বুধবার দুপুরে কুমারখালীর যদুবয়রা ইউপির বারান্দায় বসে আছেন কয়েকজন। ছবি: সমকাল
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪ | ০১:১৯
ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১টা বেজে ৪৩ মিনিট। চেয়ারম্যানের কক্ষে তখনও ঝুলছিল তালা। পরিষদের বারান্দায় কয়েকজন ইউপি সদস্যের সঙ্গে বসে আছেন গ্রাম পুলিশ সদস্য ও সাধারণ মানুষ। গতকাল বুধবার এমন চিত্র দেখা যায় কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার যদুবয়রা ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি)।
সুনসান নীরবতার মধ্যে অলস বসে ছিলেন ইউপি সচিব মো. রেজাউল ইসলাম। অথচ সপ্তাহখানেক আগেও এই ইউপি চত্বরের দুপুর গম গম করত মানুষে। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ইউপি চেয়ারম্যান আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় সব কাজ থমকে গেছে। একই অবস্থা দেশের নানা উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউপিতে।
কুমারখালী (কুষ্টিয়া): যদুবয়রা ইউপিতে বুধবার সেবা নিতে এসেছিলেন জোতমোড়া গ্রামের গৃহিণী সুরাইয়া পারভীন। তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স করতে তিন দিন ধরে ঘুরছেন। কিন্তু চেয়ারম্যান না থাকায় প্রতিদিনই ফিরে যেতে হচ্ছে বলে জানান।
সচিব মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, সরকার পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে আছেন চেয়ারম্যান। তিনি পরিষদে না আসায় মুখ থুবড়ে পড়েছে কার্যক্রম। অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন।
যদুবয়রা ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান একই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। মোবাইল ফোনে বুধবার তিনি বলেন, ৫ আগস্ট সরকার পদত্যাগের পর পরই বিরোধী দলের লোকজন বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর, চাঁদাবাজি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। তাঁর পরিষদেও এসেছিল। আপাতত পরিষদে যাচ্ছেন না তিনি। পরিবেশ শান্ত হলে ফিরবেন।
একই উপজেলার সদকী ইউপি সচিব সুকুমার বিশ্বাস জানান, চেয়ারম্যান মিনহাজুল আবেদীন দীপ কার্যালয়ে আসছেন না। লোকজনের উপস্থিতিও কম। প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে কোনোমতে চলছেন।
কয়া ইউপি চেয়ারম্যান আলী হোসেনের ভাষ্য, পরিস্থিতি ভালো নয়। পরিবেশের উন্নতি হলে পরিষদে যাবেন।
কুমারখালী পৌরসভার মেয়র সামছুজ্জামান অরুণ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি কার্যালয়ে না আসায় সব কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী ও সচিব (ভারপ্রাপ্ত) মো. ওয়াহিদুর রহমান। মেয়রকে কার্যালয়ে ফেরাতে চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
প্যানেল মেয়র এস এম রফিক মোবাইল ফোনে বলেন, আওয়ামীবিরোধী লোকজন মেয়র, প্যানেল মেয়রসহ বিভিন্ন বাড়িতে ভাঙচুর-লুটপাট করছে। পৌরসভা কার্যালয়ে গিয়েও হুমকি দিচ্ছে। ভয়ে তারা আত্মগোপনে আছেন।
ফোনে পাওয়া যায়নি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান খানকে। তাঁর পিএ রাজু আহমেদের ভাষ্য, অসুস্থতাজনিত কারণে চেয়ারম্যান ১৭ জুলাই থেকেই ঢাকায়। পরে ফেরেননি। কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বও দিয়ে যাননি তিনি। ভাইস চেয়ারম্যানরাও আসছেন না।
উপজেলা বিএনপির কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ও পান্টি ইউপি চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান ভাঙচুর-চাঁদাবাজির সঙ্গে তাঁর দলের সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘এ কথা সত্য যে, আতঙ্কে অনেক চেয়ারম্যান-মেম্বার কার্যালয়ে আসেন না। তাদের ফিরে আসার আহ্বান জানাই।’
ইউএনও এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলার কিছুটা অবনতি হয়েছিল। পুলিশ কাজে ফিরেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে টহল দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে সচেতন করা হচ্ছে। আত্মগোপনে থাকা জনপ্রতিনিধিদের কার্যালয়ে ফেরাতে যোগাযোগ চলছে।
নাজিরপুর (পিরোজপুর): ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় খোলার পরও কার্যালয়ে আসেননি উপজেলার অধিকাংশ ইউপির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। বন্ধ রয়েছে তাদের অনেকের মোবাইল ফোন। তারা পরিষদে না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেওয়া বিভিন্ন সনদ, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের মতো নাগরিক সেবা কার্যক্রম। সেবা নিতে আসা সাধারণ জনগণ পড়েছেন চরম বিপাকে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দিন আগেই নাজিরপুর ছাড়েন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম নূরে আলম সিদ্দিকী শাহীন ও ভাইস চেয়ারম্যান শেখ মোস্তাফিজুর রহমান রঞ্জু। মোস্তাফিজুর রহমান রঞ্জুর ভাষ্য, অসুস্থতার জন্য পরিষদে আসতে পারছেন না। রোববার থেকে নিয়মিত অফিস করবেন।
নাজিরপুরের ইউএনও অরুপ রতন সিংহ বলেন, কয়েকদিনে তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে তারা যদি আরও কালক্ষেপণ করেন, তাহলে নাগরিক সেবা দিতে অসুবিধা হবে। তিনি নিয়মিত কার্যালয়ে আসার বিষয়ে কথা বলেছেন। তবু না এলে বিকল্প ব্যবস্থা নেবেন।
চরফ্যাসন (ভোলা): উপজেলার ২১ ইউপির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা পালিয়ে যাওয়ায় স্থবির হয়ে পড়েছে কার্যক্রম। সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন প্রায় ৭ লাখ মানুষ। চেয়ারম্যানদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন বলে নিরাপত্তার জন্য পরিষদে যাচ্ছেন না।
জাহানপুরের বাসিন্দা মাওলানা ইউসুব হোসেন বলেন, শিশুপুত্রকে মাদ্রাসায় ভর্তি করানোর জন্য জন্মনিবন্ধন জরুরি। পরিষদে সচিব ও চেয়ারম্যান না থাকায় জন্মনিবন্ধন করতে পারছেন না। প্রতিদিনই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। ছেলের ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
জাহানপুর ইউনিয়নের জলিল বেপারি বাজারের ব্যবসায়ী ব্যবসায়ী জিয়া উদ্দিন বলেন, তাঁর ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন জরুরি। চেয়ারম্যান পরিষদে না থাকায় তা করতে পারছেন না।
জিন্নগড় ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জামাল মোল্লার ভাষ্য, চেয়ারম্যান না থাকায় সেবাপ্রার্থীরা বিপাকে পড়েছেন। পাশাপাশি জেলেদের ভিজিএফ ও ভিজিডি চাল এবং টিসিবির পণ্য বিতরণের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন বলে জানান ওই ইউপির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন মিয়া। তিনি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরিষদে যাবেন।
ইউএনও নওরীন হক বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বাঁশখালী (চট্টগ্রাম): শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাঁশখালী পৌরসভার মেয়র তোফাইল বিন হোছাইনসহ উপজেলার অধিকাংশ ইউপি চেয়ারম্যান ও জনপ্রতিনিধি এখন লাপাত্তা। তাদের অফিস ফাঁকা পড়ে আছে।
যেসব ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী চেয়ারম্যান হিসেবে জয়ী হন, তারা পরিষদে যাচ্ছেন। তারা হলেন– পুঁইছড়ির তারেকুর রহমান, সাধনপুরের কে এম সালাহউদ্দিন কামাল, পুকুরিয়ার আসহাব উদ্দিন, শেখেরখীলের মোরশেদুল ইসলাম ফারুকী ও বাহারছড়ার রেজাউল করিম ইউনুস। গণ্ডামারা ইউপি চেয়ারম্যান লেয়াকত আলী কারাগার থেকে মুক্ত হলেও ইউনিয়ন পরিষদটি এখনও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে।
চট্টগ্রাম-১৬ আসনের দু’বারের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর খোঁজও মিলছে না। গত জুনে সাংবাদিক ও তাঁর প্রতিপক্ষ কয়েকজনকে গালাগাল ও হুমকি ভাইরাল হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে একটি ও হুমকির বিষয়ে পৃথক মামলা হয়। এর পর থেকেই আত্মগোপনে ছিলেন মোস্তাফিজ। সরকার পরিবর্তনের পর তাঁর চাচা চেয়ারম্যান রশিদ আহমদ, তাঁর মেয়ে যুব মহিলা লীগ নেত্রী রওকত নুর প্রিয়তারও হদিস নেই। উপজেলার যেসব জনপ্রতিনিধি পালিয়ে আছেন, তারা হলেন– পৌরসভার মেয়র তোফাইল বিন হোছাইন, ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ, শীলকূপের কায়েস সরওয়ার সুমন, বৈলছড়ির কফিল উদ্দিন, সরলের রশীদ আহমদ চৌধুরী, খানখানাবাদের জসীম উদ্দিন হায়দার, কালীপুরের শাহাদাত আলম ও কাথরিয়ার ইবনে আমিন। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে হুমকি দিয়ে আলোচনায় আসেন চাম্বল ইউপির চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী। গত ৪ আগস্ট জামায়াত নিয়ন্ত্রিত চাম্বল জেনারেল হাসপাতালে অগ্নিসংযোগ ও ছাত্রদের মারধরের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। মুজিবুলের দেখাও পাচ্ছেন না কেউ।
বুধবার পর্যন্ত কার্যালয়ে যাননি উপজেলা চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোছাইন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নুরীমন আক্তার। খোরশেদ আলমের ভাষ্য, তিনি এলাকায়ই আছেন। পরিবেশের উন্নতি হলে নিয়মিত অফিস করবেন তিনি।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন কুমারখালী (কুষ্টিয়া), নাজিরপুর (পিরোজপুর), চরফ্যাসন (ভোলা) ও বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
- বিষয় :
- কুষ্টিয়া
- ইউনিয়ন পরিষদ