পাহাড়ে দ্রোহের গ্রাফিতি আঁকায় বাধা, মুছে দেওয়ায় ক্ষোভ

মুছে ফেলা হয়েছে নিখোঁজ কল্পনা চাকমাকে নিয়ে আঁকা গ্রাফিতি। সোমবার খাগড়াছড়ি শহরের আদালত সড়ক এলাকায় সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪ | ০০:৪৮
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সারাদেশে দেয়ালে দেয়ালে দ্রোহের গ্রাফিতি আঁকা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে দেশের তিন পার্বত্য জেলা– রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানেও চলছে এই ধরনের আঁকাআঁকি। পাহাড়ি এলাকায় মূলত আদিবাসী শিক্ষার্থীরাই এই আঁকাআঁকির কাজটির মাধ্যমে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। তবে এসব গ্রাফিতি আঁকায় বাধা প্রদান ও মুছে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এর প্রতিবাদে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ-সমাবেশও করেন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, পাহাড়ের আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা, বৈষম্যের শিকার। একটা দেশে দুই নীতির শাসন চলতে পারে না। সমতলে গণতন্ত্র থাকলে পাহাড়েও থাকতে হবে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সারাদেশে গত ১০ আগস্ট থেকে পাহাড়ি আদিবাসী শিক্ষার্থীরাও তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন স্থানে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন শুরু করেন। তারা নিজেদের উদ্যোগে রংসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কিনে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা শহরের জীর্ণশীর্ণ, বিবর্ণ, মলিন, প্রাণহীন অনেক দেয়ালে তুলির আঁচড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত মুগ্ধ ও আবু সাঈদের গ্রাফিতি ছাড়াও পাহাড়ের মানুষের না বলা কথাগুলো তুলে ধরছেন। যুগ যুগ ধরে শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা, সমঅধিকার, বৈষম্য, সাম্য, অসাম্প্রদায়িক, বিপ্লব ও প্রতিবাদের চিত্রগুলো আঁকছিলেন তারা।
এসব গ্রাফিতি পথচারী থেকে সবার নজর কাড়ে। তবে ১২ আগস্ট খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের দেয়ালে শিক্ষার্থীরা গ্রাফিতি অঙ্কনের সময় নিরাপত্তা বাহিনী বাধা প্রদান, হামলা, লাঠিচার্জ ও রঙের কৌটা লাথি মেরে ফেলা দেয়। পাহাড়ে বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে গুম হওয়া কল্পনা চাকমার প্রতিকৃতি মুছে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন তারা। এসব বাধা প্রদান ও গ্রাফিতি মুছে দেওয়ার খবরে পাহাড়ি সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং অধিক মাত্রায় পাহাড়ের তিন জেলা শহর ছাড়াও উপজেলাসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতি অঙ্কন শুরু হয়।
গ্রাফিতি অঙ্কনে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে বাধা দেওয়ারও অভিযোগ করা হয়েছে। এ ঘটনায় গত ১৬ আগস্ট রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে গ্রাফিতি অঙ্কনের প্রতিবাদে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ-সমাবেশে করেন। শিক্ষার্থীরা আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকারসহ নায্য দাবি পূরণ না হওয়া পর্ষন্ত সবাইকে একত্রিত হয়ে এ আন্দোলন আরও তীব্রভাবে চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
অরপদিকে, রোববার পাহাড়ে গ্রাফিতি মুছে দেওয়ার প্রতিবাদে ও পাহাড়ে বৈষম্যের মুক্তির দাবিতে রাঙামাটির জিমনেশিয়াম প্রাঙ্গণে গানে গানে প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় আদিবাসী সাংস্কৃতিক কর্মীরা। তারা আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সংগীত বিষয়ে জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তকরণ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিবর্তে আদিবাসী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট করার দাবি জানিয়েছেন।
রাঙামাটিতে গ্রাফিতি অঙ্কনে নেতৃত্বদানকারী কিকো দেওয়ান জানান, শহরের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও মহালছড়িতে চিত্রকর্ম মুছে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কল্পনা চাকমার গ্রাফিতি অঙ্কন না করতে নিষেধ করে, অঙ্কন করলে তাদের তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঘাইছড়িতে গ্রাফিতি অঙ্কনের এক সমন্বয়ক জানান, শিক্ষার্থীরা দেয়ালে গ্রাফিতি অঙ্কনের সময় একদল বাঙালি বাধা দেয়। তবে তারা গ্রাফিতি মুছে দিতে পারেনি। তবে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে বাধা প্রদানকারীরা স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।
খাগড়াছড়িতে নাম না প্রকাশের শর্তে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের এক সমন্বয়কারী জানান, ১২ আগস্ট দুপুরের দিকে খাগড়ছড়ি সরকারি কলেজের দেয়ালে গ্রাফিতি অঙ্কনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাধা, লাঠিচার্জ ও রঙের কৌটা লাথি মেরে ফেলে দেয়। এ সময় এক শিক্ষার্থীকে তুলে নিলেও পরে ছেড়ে দেয়।
অন্যদিকে, বান্দরবানের রুমা উপজেলায় গ্রাফিতি আঁকার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি দল শিক্ষার্থীদের বাধা দেয় বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। কী কী বিষয় নিয়ে লেখা ও আঁকা হবে, সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে অনুমতি নিতে বলা হয়।
দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি অঙ্কনে নেতৃত্ব দেওয়া শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অংশৈ সিং ও শৈ হাই মং মারমা জানান, রুমা উপজেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়াল ও বাউন্ডারিগুলোতে পাহাড়ে তাদের চাপা কষ্টের কথা, মাতৃভাষার বর্ণামালায় সচেতনতামূলক ও শিক্ষণীয় কিছু গ্রাফিতি অঙ্কন ও দেয়াল লিখন শুরু করেছিলেন তারা। পরে রুমা বাজার ক্যাম্পে তাদের ডেকে নানা ধরনের হুমকি ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়। তাদের এনআইডি কার্ডের ফটোকপি, মোবাইল ফোন, পারিবারিক পরিচয় ও ঠিকানা দিতে বাধ্য করা হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর অনুমতি নিয়ে রোববার সকাল থেকে তারা শুধু তাদের বাছাইকৃত স্লোগান আঁকতে পেরেছেন। এ ছাড়া তাদের কষ্ট ও বেদনার কথা লিখতে পারছেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রুমা বাজার সেনা ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর সোহেল সাংবাদিকদের জানান, শনিবার বেশ কিছু ছেলেমেয়ে দেয়াল লিখন এবং গ্রাফিতি অঙ্কনের উদ্যোগ নিলে তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে বুঝিয়েছি, রুমায় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার পর থেকে পরিস্থিতিটা সারাদেশের তুলনায় একটু ভিন্ন। সামান্য একটি শব্দ দিয়ে কত কিছু হয়ে যায়। আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে রুমায় সব নাগরিকের উপজেলা ত্যাগ, বাজার-ফসলাদি বেচাবিক্রিসহ সব ক্ষেত্রে অনুমতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদেরও সে অনুযায়ী অনুমতিপত্র দিতে বলেছিলাম। কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি।
- বিষয় :
- গ্রাফিতি