রেলের টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রক ছিলেন ‘দুবাইওয়ালা’ বাবর

.
তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৪ | ০০:৪১
রেলওয়ের দরপত্র, ইজারা, দখল-বাণিজ্য– এসবের নিয়ন্ত্রক ছিলেন চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী কথিত যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারকে কমিশনের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিজেও কাজ বাগিয়ে নিতেন এ নেতা। খোদ রেলওয়ের অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশেই এসব অপকর্ম করত বাবর বাহিনী। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের আশীর্বাদ থাকায় ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন বাবর।
চক্রটির হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিল গোটা রেলওয়ে। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো সাধারণ ঠিকাদার কাজের দরপত্র নিতে পারতেন না। প্রভাব বিস্তারে খুনোখুনি করতেও দ্বিধা ছিল না তাদের। বাবরের বিরুদ্ধে শুধু খুনের মামলাই রয়েছে এক ডজনের বেশি। তাঁর রয়েছে গাড়ি-বাড়িসহ বিপুল বিত্তবৈভব। অবৈধপথে আয়ের বড় একটি অংশ পাচার করেছেন দুবাইয়ে। সেখানেও রয়েছে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য। দুবাইয়ে আসা-যাওয়া করে বাহিনীর মাধ্যমে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন বাবর। তাই অনেকের কাছে ‘দুবাইওয়ালা’ নামেও পরিচিত বাবর।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদরদপ্তর চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং-সিআরবিতে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা এখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ করে রেলওয়ের ঠিকাদারি কাজকর্ম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘুরেফিরে রেলের বিভিন্ন কাজ পেয়ে থাকে হাতেগোনা কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এদের মূল হোতা শাহ আলম। তাঁর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নাম এসএ করপোরেশন ও ইউনিক ট্রেডার্স। গত দেড় দশকে রেলে তিনিই সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছেন। বেশির ভাগ কাজ পেতে ব্যবহার করেছেন বাবরকে। এক সময় যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শাহ আলম সরকার পতনের পর গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাঁর তিনটি মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও বন্ধ পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে একাধিক ঠিকাদার জানিয়েছেন, শাহ আলমসহ হাতেগোনা কয়েকজনই সব সময় রেলের কাজ পান। অন্য ঠিকাদার কোনোভাবে কাজ পেলে তাদের কমিশন না দিয়ে কাজ করা সম্ভব হতো না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সব সময় দরপত্রে স্বচ্ছতা রাখার চেষ্টা করি। এরপরও দরপত্র নিয়ে যে ঝামেলা হতো না, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা প্রকাশ্যে আসতেন না। তবে এখন তেমন কোনো কাজ নেই, তাই তাদের আনাগোনাও নেই।’
জানা যায়, চট্টগ্রামের এমইএস কলেজভিত্তিক ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন বাবর। তিনি এ কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন। প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন বাবর। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাঁর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বাবর। তিনি ছাত্রলীগ-যুবলীগের একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা আশিককে হত্যা, রাউজানের আকবর-মুরাদ হত্যা, বিএনপিকর্মী আজাদ হত্যা, মির্জা লেনে ডাবল মার্ডার, তামাকুণ্ডি লেনে রাসেল হত্যা, ফরিদ হত্যার অভিযোগে মামলা রয়েছে। ২০১৩ সালের ২৪ জুন দরপত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সিআরবিতে যে সংঘর্ষ হয় তাতে শিশু আরমান ও সাজু পালিত নামে এক ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হন। ওই ঘটনায় সাজুর মায়ের দায়ের করা মামলায়ও নাম রয়েছে বাবরের। সর্বশেষ গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর বাবরের নেতৃত্বে হামলা চালায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ। এতে প্রাণ হারান তিনজন।
সূত্র জানায়, ২০১১ সালে জেল থেকে বের হয়ে ব্যাংককের আদালতের মাধ্যমে ট্যুরিস্ট পাস নিয়ে পাড়ি জমান দুবাই। সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট বানিয়ে দেশে ফেরেন ২০১২ সালে। এরপর প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ বাগিয়ে ফের বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সিআরবিতে সংঘটিত জোড়া খুনের ঘটনায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার হলে যুবলীগ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। পরে জামিনে বেরিয়ে ২০১৮ সালে ফের দুবাই পালিয়ে যান। এরপর ২০২১ সালে দেশে ফিরেই রেলওয়েকেন্দ্রিক টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে সুযোগ বুঝে ফের দুবাইয়ে পালিয়ে যান তিনি।
একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে এখন শতকোটি টাকার মালিক বাবর। নন্দনকানন বৌদ্ধমন্দির রোডে রয়েছে তাঁর পাঁচতলা বাড়ি। ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ডি-ব্লকের ২ নম্বর রোডের (বড় মসজিদের পাশে) ২৩/১ নম্বরের বাড়ির চারতলায় রয়েছে ফ্ল্যাট। ঢাকার বনানীতে দুটি সাততলা বাড়ি। নন্দনকানন ২ নম্বর গলিতে তাঁর স্ত্রীর নামে তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট এবং স্টেশন রোডে একটি বারসহ নামে-বেনামে রয়েছে বেশ কয়েকটি গাড়ি।
- বিষয় :
- টেন্ডার