চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
জনবল প্রয়োজনের দ্বিগুণ, তবু যেমন খুশি নিয়োগ
বিজ্ঞাপন-পরীক্ষা ছাড়াই ৩০০ কর্মী নিয়োগ দেন সাবেক মেয়র

ফাইল ছবি
আব্দুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:৪৭ | আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০৯:২৬
শায়লা শারমিন মুমু। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) পরিচালিত কলেজে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তখন চসিক সচিবের দায়িত্বে ছিলেন তাঁর বাবা খালেদ মাহমুদ। কোনো নিয়োগ প্রক্রিয়া ছাড়াই বাবার স্বাক্ষরে চাকরি পান তিনি। শুধু শায়লা শারমিন নন, সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর সাড়ে তিন বছরে অন্তত ৩০০ জন এভাবে নিয়োগ পেয়েছেন। এসব
নিয়োগের জন্য কখনও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি
দেওয়া হয়নি। নেওয়া হয়নি পরীক্ষাও। শুধু আবেদনের ভিত্তিতেই শ্রমিক থেকে শুরু করে কলেজশিক্ষক পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বেতনও নির্ধারণ করা হয়েছে মেয়র ও সচিবের মর্জি মতো। শ্রমিক পদে নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করছেন কেউ কেউ।
এসব নিয়োগে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সিটি করপোরেশনের নথিপত্র অনুযায়ী, বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুযায়ী মোট পদ রয়েছে ৪ হাজার ২২৬টি। এসব পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৮ হাজার ২৪৫ জন। মূল পদের বিপরীতে বাড়তি জনবল আছে ৪ হাজারের বেশি। এর পরও নতুন নতুন নিয়োগে থেমে থাকেনি রেজাউল-খালেদ চক্র।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী। ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব নেন। ৯ মার্চ চসিকের সচিব পদে আসেন খালেদ মাহমুদ। এর পর জুটি বেঁধে একের পর এক নিয়োগ দিতে থাকেন।
যেভাবে নিয়োগ
অন্তত ৫০ জনের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পছন্দের চাকরিপ্রার্থীর আবেদনে ‘বিধিমতে ব্যবস্থা নিন’ লিখে সচিবকে নির্দেশনা দিতেন মেয়র রেজাউল। সচিব নথি তৈরি করে মেয়রের কাছে উপস্থাপন করতেন। মেয়র সেখানে ‘কাজ নেই, মজুরি নেই’ ভিত্তিতে শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত করা হউক’ লিখে অনুমোদন দিতেন। এর পর চাকরিপ্রার্থীকে মর্জি মতো বেতন নির্ধারণ করে নিয়োগপত্র দিতেন সচিব।
দুই দফা বদলি ঠেকিয়ে তৃতীয় দফা বদলিতে গত ২০ ফেব্রুয়ারি চসিক ছাড়েন সচিব খালেদ মাহমুদ। তাঁর বদলির আগ পর্যন্ত ৩০০ জনের বেশি কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১২ ফেব্রুয়ারি খালেদ মাহমুদের বদলির আদেশ হয়। সেই দিনও তিনি সিটি করপোরেশন পরিচালিত কলেজে প্রভাষক পদে রোকেয়া বেগম নামে এক নারীকে নিয়োগ দেন।
রেজাউল-খালেদ চক্র যেসব নিয়োগ দিয়েছেন, তার মধ্যেও একই পদের চাকরিতে বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে মর্জি মতো।
গুরুতর অনিয়ম
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কর্মচারী চাকরি বিধিমালার ৪ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল পদ উন্মুক্ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূরণ করা হবে।’ পরের ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে করপোরেশন কর্তৃক নিযুক্ত বাছাই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হবে।’ কিন্তু সাবেক মেয়র সেসবের কিছুই মানেননি।
সরকারি চাকরির বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, এ ধরনের নিয়োগ মারাত্মক অনিয়ম। এ বিষয়ে দুদকের ব্যবস্থা
নেওয়া উচিত।
সিটি করপোরেশনের সাবেক সচিব খালেদ মাহমুদ বর্তমানে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালকের (মেলা) দায়িত্বে আছেন। মন্তব্য জানতে তাঁকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগের বিষয়ে খালেদের মেয়ে শায়লা শারমিন মুমু বলেন, ‘কোনো বিজ্ঞপ্তি দেখে নয়, আবেদন করে নিয়োগ পেয়েছি।’ এ কথা বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। এর পর আর ফোন ধরেননি।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর রেজাউল করিম চৌধুরী আত্মগোপনে চলে যান। তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, নিয়োগে যদি অনিয়ম হয়, প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অস্থায়ী শ্রমিক থেকে প্রকৌশলী
২০২৩ সালে নিয়মবহির্ভূতভাবে অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে সিটি করপোরেশনে নিয়োগ পান রাহুল মজুমদার। ৩ জুলাই তাঁকে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের প্রকিউরমেন্ট শাখায় ন্যস্ত করা হয়। দুই মাসের মাথায় তাঁকে একই বিভাগের অফিস সহকারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। আরেক অফিস আদেশে তাঁকে উপসহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি বছরের ১৪ মার্চ তাঁকে প্রকিউরমেন্ট অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে রাহুল মজুমদার শুরুতে বলেন, ‘আমি কীভাবে নিয়োগ পেয়েছি, আমার পরিবার জানে।’ পরে আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সাবেক সচিব খালেদ মাহমুদ আমার পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দিয়েছেন।’ কেউ ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষা নিয়ে কাউকে নিয়োগ দিতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, ‘অন্য কারও বিষয় জানি না। আমার পরীক্ষা তিনি নিয়েছেন। পরে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা দেখে মেয়রের নির্দেশে পদোন্নতি হয়েছে।’
এ ছাড়া গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সিটি করপোরেশন পরিচালিত কলেজে চাকরি পান মো. তানভীর হোসেন। পরে তাঁকে আইটি শাখার সহকারী প্রোগ্রামার হিসেবে পদায়ন করা হয়। তানভীর হোসেন সমকালকে বলেন, ‘বিজ্ঞাপন নয়, সিটি করপোরেশনের লোকজনের কাছে খবর পেয়ে আবেদন করে নিয়োগ পেয়েছি। প্রথমে একটি প্রকল্পে কাজ করতে দেওয়া হয়। পরে সহকারী প্রোগ্রামারের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়।’
নিয়মবহির্ভূত এসব নিয়োগে কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ করেন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি কাজী মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। তিনি বলেন, ‘নিয়মবহির্ভূতভাবে শত শত কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগের সময় তাদের কাছ থেকে এক দফা টাকা নিয়েছে। শ্রমিক হিসেবে নিয়োগের পর বিভিন্ন পদে পদায়নের জন্য তাদের কাছে কয়েক দফায় টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসবের সঙ্গে মেয়রের পাশাপাশি কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও শ্রমিক নেতারা জড়িত।’
- বিষয় :
- চসিক
- নিয়োগ বাণিজ্য
- প্রকৌশলী