ইহতিশামুলের মৃত্যুতে ঘোর অন্ধকারে পরিবার

শেখ ইহতিশামুল হক
জাকির হোসেন, আমতলী (বরগুনা)
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:২২
স্বামীর সঙ্গে ইল্লিন বেগমের বিচ্ছেদ হয় বছর সাতেক আগে। খুলনায় অবস্থিত স্বামীর বাড়ি থেকে তখন তিন ছেলে নিয়ে চলে আসেন বরগুনার আমতলী পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সিকদারবাড়ি এলাকায়। এখানেই বাবার বাড়ি তাঁর। বৃদ্ধ মা হামিদা বেগমের সঙ্গে থাকা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে কঠোর পরিশ্রমে বড় করতে থাকেন ছেলেদের। বড় ছেলে শেখ ইহতিশামুল হক (১৭) পড়াশোনার পাশাপাশি কয়েক বছর আগে কাজ শুরু করে ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে। সেই ছেলে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এক জনপ্রতিনিধির বাসায় দেওয়া আগুন নেভাতে গিয়ে দগ্ধ হয়। ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা যায় সে।
শনিবার সিকদারবাড়ি এলাকায় গিয়ে কথা হয় ইল্লিন বেগমের সঙ্গে। তোতলানোর সমস্যা থাকায় কথা বলতে সমস্যা হয় তাঁর। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর এক কাপড়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মোর মায় ব্যামালা (প্রচুর) কষ্ট হরছে। হেইয়ার পর পোলাডায় বড় অইয়া ল্যাহাপড়া করার পাশাপাশি কারেন্টের কাম কইর্যা সংসার চালাইতো। আবার ছোড দুই ভাইয়ের ল্যাহাপড়ার খরচও দিত। এহন মোর পোলাডায় মইর্যা গ্যাছে! কি দিয়া মুই সংসার চালামু, আর পোলা দুইডার ল্যাহাপড়া করামু?’
ইহতিশামুল হক পড়ত আমতলী শেখ হাসিনা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণিতে। তার বিষয় ছিল আইটি সাপোর্ট অ্যান্ড আইওটি বেসিকস। পাশাপাশি ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে যে আয় হতো, সেই আয়ে সংসার খরচ চালাত। মেজো ভাই শেখ আসাদ উল্লাহ রায়হান (১৫) ভাইয়ের সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানে নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ভাই শেখ হোসাইন আহম্মেদ ত্বোহা (১২) ওয়াবদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। তাদের বাবা শেখ মো. রবিউল ইসলাম খুলনার বাসিন্দা।
ইল্লিন বেগমের বোন আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর ঢাকায় যেতে চেয়েছিল ইহতিশামুল। বারবার সে বলত, আন্দোলনে জয়ী হয়ে ফিরবে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আয়েশা বলেন, ‘বাবা, ও ঠিকই বাসায় আইছে; জীবিত নয়, লাশ হইয়া।’ তার মৃত্যুর পর পরিবারের এখন পথে বসার দশা। তিনি আশা করেন, সরকার তাদের পাশে দাঁড়াবে।
স্বজন ও এলাকাবাসীর ভাষ্য, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর আমতলী পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. মতিয়ার রহমানের বাসভবনে ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সংবাদ পেয়ে সেখানে যায় ইহতিশামুল। অন্যদের সঙ্গে আগুন নেভাতে গিয়ে ভেতরে আটকা পড়ে সে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর এলাকাবাসী তাঁকে উদ্ধার করে আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা তাৎক্ষণিক তাকে বরিশাল শেরেবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে (শেবাচিম) পাঠান। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ৬ আগস্ট ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ সেপ্টেম্বর মারা যায় এই কিশোর। পরদিন জানাজা শেষে নানাবাড়ির গোরস্তানে তাকে দাফন করা হয়।
ইহতিশামুলের ভাই শেখ মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ রায়হান বলে, ‘বাবা থাইক্যাও নাই। বড় ভাইয়ের আদর-ভালোবাসার কারণে কখনও বাবার অভাব বুঝতে পারি নাই। আমাদের এতিম করে ভাই আমার চলে গেছে। এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না।’ তার অভিযোগ, ‘দুর্বৃত্তরা আমার ভাইকে আগুনে ঠেলে দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। আমি এ হত্যার বিচার চাই।’
আমতলী শেখ হাসিনা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শান্তিরঞ্জন সরকার বলেন, খুবই ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের ছাত্র ছিল ইহতিশামুল। লেখাপড়ায়ও ভালো ছিল। তার মৃত্যুর পর কলেজের পক্ষ থেকে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। অন্যদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
- বিষয় :
- আগুনে নিহত