ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

অবৈধ চিকিৎসাকেন্দ্রের ছড়াছড়ি

অবৈধ চিকিৎসাকেন্দ্রের ছড়াছড়ি

প্রতীকী ছবি

 আনোয়ার হোসেন মিন্টু, জামালপুর

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:০৮

জামালপুরে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান চলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই।
অভিযোগ রয়েছে, এসব হাসপাতাল বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। তাদের নেই কোনো জরুরি বিভাগ, রোগ নির্ণয়ের মানসম্মত যন্ত্রপাতি ও ল্যাব টেকনোলজিস্ট। ধার করা চিকিৎসক দিয়ে চলছে জটিল অপারেশনসহ নানা চিকিৎসা।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, জামালপুরে অনুমোদনপ্রাপ্ত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগস্টিক সেন্টারের সংখ্যা দেড় শতাধিক। যদিও বাস্তবে এর সংখ্যা আরও বেশি।
সরেজমিন দেখা গেছে, জেলা শহর ছাড়াও উপজেলার অলিগলিতে চোখ ধাঁধানো ব্যানারসহ ডিজিটাল সাইনবোর্ড। তাতে রয়েছে স্বনামধন্য চিকিৎসকদের তথ্যাবলি। এসব দেখে গ্রামের সহজ-সরল মানুষ ফাঁদে আটকে যাচ্ছেন।
ভুক্তভোগীদের দাবি, জেলা শহরের গুটিকয়েক হাসপাতাল ছাড়া অধিকাংশেই চলছে চিকিৎসার নামে গলাকাটা ব্যবসা। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব হাসপাতালে গিয়ে অপচিকিৎসার জালে আটকা পড়ছেন রোগী। অকালে ঝরে যাচ্ছে অনেক প্রাণ।

অভিযোগ রয়েছে, প্রতিদিন শহরের অলিগলিতে নানা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঢাকা-ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের বড় বড় ডিগ্রিধারী চিকিৎসক বসার কথা প্রচার করা হচ্ছে। বাস্তবে অনেকের ডিগ্রি কদম আলীর মতো। স্বনামধন্য চিকিৎসকের নাম ভাঙিয়ে ও অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে রোগীর গাঁটের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো ধরনের মনিটর না থাকায় অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশির ভাগ হাসপাতালে বড় বড় চিকিৎসকের নামসংবলিত সাইনবোর্ড টানানো থাকলেও তাদের অনেকেই অনেক আগেই বদলি হয়ে চলে গেছে ভিন্ন কোনো জেলায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাসে দু-একবার এসে অপারেশন করে চলে যান। তা ছাড়া নেই মানসম্মত পরীক্ষাগার, প্যাথলজিক্যাল সরঞ্জাম বা ল্যাব টেকনোলজিস্ট। কম বেতনের অনভিজ্ঞ নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়াই হচ্ছে এসব হাসপাতালের রোগীদের একমাত্র ভরসা।

জামালপুর স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে ১২৭টি। তার মধ্যে ২০২৩-২৪ সাল পর্যন্ত লাইসেন্স নবায়ন আছে ২৩টির। বাকিগুলো রয়েছে সাময়িক অবৈধ তালিকায়। এ ছাড়া জামালপুর সদরের সূর্যের হাসি ক্লিনিক, মাস্টার ডায়াগনস্টিক, দানিয়ান ডায়াগনস্টিক, মা মেডিকেল হল, হাসিল ডায়াগনস্টিক, নিউ ইউনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সরিষাবাড়ীর মাতৃছায়া জেনারেল হাসপাতাল, গোলাপ জেনারেল হাসপাতাল, প্রফেসর শহীদুর রহমান খান ডায়াবেটিক সেন্টার, আল মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মাদারগঞ্জের ইউনিক হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফাতেমা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, দেওয়ানগঞ্জের এশিয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার, জিহাদ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মোল্লা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার, ইসলামপুরের মা ডিজিটাল জেনারেল হাসপাতাল, হযরত শাহজামাল (রহ.) ডায়াবেটিস ও চক্ষু হাসপাতাল ও মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার কোনো প্রকার অনুমোদন ছাড়াই চলছে।

সাবেক ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খানের ছোট ভাই মোরশেদুর রহমান মাসুম খানের ইসলামপুরে ১০ শয্যার যমুনা হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অবৈধভাবে চলছে দুই বছর ধরে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে থাকায় মাসুম খানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর অংশীদার রফিকুল ইসলাম বলেন, দেশে যেভাবে শত শত হাসপাতাল লাইসেন্স ছাড়া চলছে, তারাও সেভাবে চালাচ্ছেন।

মেলান্দহে ১০ শয্যার আলহাজ এম এ রশিদ জেনারেল হাসপাতাল প্রায় চার বছর ধরে চলছে অবৈধভাবে। হাসপাতালটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন নয়ন জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় আবেদন করে দীর্ঘদিনেও লাইসেন্স পাচ্ছেন না।

জামালপুর কলেজ রোডের আল মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারটির মালিক ডাক্তার আহম্মদ আলী আকন্দ। এখানে নিয়মিত যক্ষ্মা রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র দেন তিনি। নিজে একজন চিকিৎসক হয়েও কেন অবৈধভাবে ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালাচ্ছেন তার কোনো সদুত্তর নেই তাঁর কাছে।
সম্প্রতি জামালপুর শহরের কয়েকটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালায় স্বাস্থ্য বিভাগ। এ সময় কলেজ রোডের ডা. আহম্মদ আলী আকন্দের আল মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে লাইসেন্সের হালনাগাদ, পরিবেশের ছাড়পত্র, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও টেকনোলজিস্ট না থাকা এবং ল্যাবের ত্রুটি ধরা পড়ে। পরে এসব সংশোধনের জন্য এক মাসের সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
জামালপুর ডায়াবেটিস জেনারেল হাসপাতালের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ তারিকুল ইসলাম বলেন, লাইসেন্স নবায়নের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে পদে পদে হয়রানি হতে হয়। তাঁর ভাষ্য, পরিবেশের ছাড়পত্র পেতে একটি নথিপত্র তৈরিতে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। তিনি নিজেও অনেক দিন ঘুরে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে পরিবেশ ছাড়পত্র পেয়েছেন।
সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা উত্তম কুমার সরকার জানান, সদর উপজেলার যেসব চিকিৎসা কেন্দ্র স্বাস্থ্য বিভাগের নীতিমালা উপেক্ষা করে চলছে তাদের কার্যক্রম নিয়মিত পরিদর্শন করছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রতিবেদন দিচ্ছেন।
সিভিল সার্জন ফজলুল হক বলেন, অবৈধ চিকিৎসা কেন্দ্রের তালিকা করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসককে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিয়মিত পরিদর্শন অব্যাহত আছে।
 

আরও পড়ুন

×