ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ভুয়া নাম-ঠিকানায় আট আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স

ভুয়া নাম-ঠিকানায় আট  আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স

.

আনোয়ার হোসেন মিন্টু, জামালপুর

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:৩০

লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ থানায় জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল গত ৩ সেপ্টেম্বর। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের বেঁধে দেওয়া এ সময়ের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেয়নি জামালপুরের আট ব্যক্তি। প্রায় এক মাস ধরে প্রদত্ত ঠিকানায় হন্যে হয়ে খুঁজেও তাদের সন্ধান পাচ্ছে না পুলিশ। এমনকি গ্রামের স্থায়ী ঠিকানায়ও ওই অস্ত্রধারীদের চেনে না কেউ। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, অস্ত্র-গোলাবারুদের আবেদনকারীদের স্থায়ী ঠিকানা যাচাই-বাছাই, ভোটার আইডি ও পুলিশি রিপোর্ট ছাড়াই এসব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে কিনা।
জামালপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত জেলায় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে ৩১৩টি। তার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের গত ২৫ আগস্ট জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী জেলার জমাযোগ্য অস্ত্র ১৯৯টি। তবে জমা পড়েছে ১৯১টি। জমা হয়নি আটটি। এর মধ্যে রয়েছে সদর উপজেলার তিনটি, মেলান্দহের দুটি, মাদারগঞ্জের দুটি ও সরিষাবাড়ীর একটি অস্ত্র। নির্ধারিত সময়ে এসব আগ্নেয়াস্ত্র জমা না দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ ওই অস্ত্রধারীদের হন্যে হয়ে খুঁজছে। কিন্তু গত প্রায় এক মাসেও ওইসব অস্ত্রের মালিকদের সন্ধান পায়নি পুলিশ।
সরিষাবাড়ী উপজেলার মহাদান বারুইপটল গ্রামের বাসিন্দা জালাল মিয়া জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নেন ২০১৬ সালে। তবে কী ধরনের অস্ত্র নিয়েছেন, তা উল্লেখ নেই জেলা প্রশাসনের রেজিস্টারে। আগ্নেয়াস্ত্র রেজিস্টার রক্ষণাবেক্ষণকারী কর্মকর্তা এসআই শহীদ বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জালাল মিয়ার নামে ইস্যু করা আগ্নেয়াস্ত্র জমা না হওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে একাধিকবার ওই গ্রামে যান তিনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও জালাল মিয়ার সন্ধান পাননি। এমনকি জালাল নামের কাউকে চেনেন না ওই এলাকার জনপ্রতিনিধি বা গ্রামের অন্য কেউ।
মাদারগঞ্জ উপজেলার গুনারিতলা গ্রামের বাসিন্দা ল্যান্স করপোরাল শাহ আলম ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই শটগানের লাইসেন্স নেন। ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই একই শ্রেণির আগ্নেয়াস্ত্র নেন জুনাইল গুনারিতলা গ্রামের সার্জেন্ট মোস্তফা সরদার। তবে সরকারের বেঁধে দেওয়া সময় অতিবাহিত হলেও এই দু’জন আগ্নেয়াস্ত্র থানায় জমা দেননি বলে জানান মাদারগঞ্জ থানার ওসি শাহিনুর রহমান। তাঁর দাবি, এলাকায় খোঁজাখুঁজি করেও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিকানা অনুযায়ী নিজ গ্রামেও কোনো বাড়ি নেই তাদের।
মেলান্দহ থানার ভাঙ্গুনী ডাঙ্গা গ্রামের সার্জেন্ট কামাল হোসেন আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নেন ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর। আর সুলতানখালী দুরমুট গ্রামের একিন আলী সিকদারের ছেলে নজরুল ইসলাম লাইসেন্স নেন ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। দু’জনের কেউ অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেননি। থানার অস্ত্র তদারকি কর্মকর্তা এসআই রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি ওই দুই গ্রামে একাধিকবার গিয়েও তাদের সন্ধান পাননি। তাদের চেনেন না বলে জানান গ্রামের লোকজন। তারা কেউ ওই এলাকার বাসিন্দা নয় মর্মে প্রত্যয়ন দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানরা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য, এসব আগ্নেয়াস্ত্র ইস্যু করার আগে আবেদনকারীর ভোটার আইডি ও পুলিশি রিপোর্টের তোয়াক্কা না করায় অস্ত্র চলে গেছে অজানা ঠিকানায়।
জামালপুর সদর উপজেলার নাকাটি গ্রামের ওয়ারেন্ট অফিসার ফজলুল করিম, একই গ্রামের করপোরাল আনিছুর রহমান ও মৃত কাশেম আলী সরকারের ছেলে আবদুল বাসেদ সরকার। ২০১৪ সালের শেষ দিকে অস্ত্রের লাইসেন্স নেন তারা। তবে নির্ধারিত সময়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ জমা দেননি। পাবলিক অস্ত্রের রেজিস্টার রক্ষণাবেক্ষণকারী কর্মকর্তা সদর থানার এসআই মানিক চন্দ্র দে বলেন, একই গ্রামের এই তিন অস্ত্রধারীকে হন্যে হয়ে খুঁজে কারও সন্ধান পাওয়া যায়নি। গ্রামে তাদের কোনো স্বজনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সদর থানার ওসি ফয়সল আতিক জানান, অস্ত্রের মালিক পাওয়া না গেলে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত ২৫ আগস্ট জারি করা স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য প্রদত্ত সব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়। চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে লাইসেন্সগ্রহীতার স্থায়ী ঠিকানাভুক্ত থানায় অথবা বর্তমান ঠিকানাভুক্ত থানায় অস্ত্র-গোলাবারুদ জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অস্ত্র-গোলাবারুদ থানায় জমা না দিলে অবৈধ অস্ত্র 
হিসেবে গণ্য করে লাইসেন্সগ্রহীতার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব অস্ত্রের মালিকদের ভোটার আইডি, ছবি বা পুলিশি রিপোর্ট কিছুই নেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের জুডিশিয়াল মুনশিখানার আগ্নেয়াস্ত্র ইস্যু রেজিস্টারে।
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলীর ভাষ্য, যাচাই-বাছাই না করে তৎকালীন জেলা প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এসব অস্ত্রের অপব্যবহার হবে না তারই বা নিশ্চয়তা কী?
পুলিশ সুপার সৈয়দ রফিকুল ইসলাম বলেন, আগ্নেয়াস্ত্র জমার সময় শেষ হওয়ার পর থেকেই ওইসব অস্ত্রের মালিকদের সন্ধানে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি দেশের অন্য কোনো থানায় এসব অস্ত্র-গুলি জমা হয়েছে কিনা, সেই তথ্য জানাতে দেশের সব পুলিশ সুপার বরাবর প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

আরও পড়ুন

×