রংপুর চিড়িয়াখানা
প্রাণীর খাবারে থাবা, নয়ছয় দরপত্রেও
যুব ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার সহায়তায় অনিয়মের অভিযোগ কিউরেটরের বিরুদ্ধে

রংপুর বিনোদন উদ্যান ও চিড়িয়াখানা
স্বপন চৌধুরী, রংপুর
প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪ | ২০:০০ | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪ | ২০:৪৯
রংপুর বিনোদন উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের খাবার ও ওষুধ সরবরাহে চরম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। দরপত্রে টাটকা ও পরিচ্ছন্ন খাবার দেওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদাররা সরবরাহ করছেন বাসি মজুত করা খাবার। পরিমাণের ক্ষেত্রেও করা হচ্ছে হেরফের। দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে শিশুপার্ক ও পুকুর এবং গেট ও পার্কিং এরিয়া ইজারার ক্ষেত্রেও।
এসব অনিয়মের মূলহোতা চিরিয়াখানার কিউরেটর আম্বার আলী। রংপুর প্রাণিসম্পদ বিভাগের ভেটেরিনারি সার্জন হয়েও পাঁচ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত কিউরেটরের পদ দখল করে আছেন তিনি। এসব কাজে তাঁর সহযোগী স্বেচ্ছাসেবক লীগ রংপুর মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রমজান আলী তুহিন ও যুবলীগ মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. মুরাদ। তিনজন যোগসাজশ করে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে একের পর এক অনিয়ম করে যাচ্ছেন। হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
রংপুর বিনোদন উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সিংহসহ ২০০ প্রজাতির প্রাণী আছে। এসব প্রাণীর খাবার সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রমজান আলী ও যুবলীগ নেতা মো. মুরাদ। তাদের বিরুদ্ধে প্রাণীদের জন্য নিম্নমানের ও পরিমাণে কম খাবার সরবরাহের অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী। তারা জানান, পশু-পাখির খাবারও ঠিকমতো দেওয়া হয় না। প্রতিটি বাঘ ও সিংহের জন্য প্রতিদিন ১২ কেজি মাংস দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু অর্ধেকও সরবরাহ হয় না। একই অবস্থা অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও। চিকিৎসারও যথাযথ ব্যবস্থা নেই। ঠিকমতো পরিচর্যা না করায় চার বছরে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, দুটি সিংহ, ভালুক, উটপাখিসহ ৫০টি মূল্যবান প্রাণী মারা গেছে।
কথা হয় দর্শনার্থী লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের আবু রায়হান ও অনামিকা রায়ের সঙ্গে। তারা বলেন, পশুগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। দেখেই বোঝা যায়, এদের ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয় না।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। পাঁচ আগস্টের পর থেকে তারা পলাতক। তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন যুবলীগ নেতা মুরাদের ভাই সোহরাব হোসেন। তাঁকেও একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু সাড়া মেলেনি।
চিড়িয়াখানার পুকুর ও শিশুপার্ক পরিচালনার ক্ষেত্রেও অনিয়ম করা হয়েছে। লিজ দেওয়া হলেও কিউরেটর ডা. আম্বার আলী নিজেই এর পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। ভুয়া বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। সর্বশেষ চিড়িয়াখানার গেট ও পার্কিং এরিয়া ইজারার জন্য দরপত্র আহ্বান করেও অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। গত ৬ মে গেট, পার্কিং এরিয়া ও শিশুপার্ক ইজারার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল ২৭ মে। এতে ছয়জন অংশ নেন। ১ কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকায় সর্বোচ্চ দরদাতা ছিল চৌধুরী স্টোর। কিন্তু মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে ১ কোটি ২ লাখ টাকায় কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা ছিল সুমনা এন্টারপ্রাইজকে। অনিয়মের অভিযোগ এনে চৌধুরী স্টোরের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। গত ২ জুলাই বিচারক দ্বিতীয় দরদাতার ওপর ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ রংপুর চিড়িয়াখানার কিউরেটর ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর রুল জারি করা হয়। তবে এ নির্দেশনা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, নানা অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে আম্বার আলী রংপুর নগরীর কেরানিপাড়া মহল্লার মৌবন মোড়ে ৯ শতক জমি কিনে পাঁচতলা বাড়ি করেছেন। একটি ফ্ল্যাটে সপরিবারে বসবাস করেন তিনি। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ওই বাড়ি ও জমির বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকারও বেশি। তাঁর আয়ের উৎস নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা।
অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে কিউরেটর আম্বার আলী তালুকদার বলেন, ‘আমাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কিউরেটর পদে রাখা হয়েছে। অনিয়মের সুযোগ না পাওয়ায় কেউ কেউ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’ তাঁর দাবি, খাবার বা পরিচর্যার অভাবে নয়, বাঘ ও সিংহ মারা গেছে বয়সের ভারে। দরপত্রে অনিয়ম প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য, সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রে ত্রুটি ছিল। এ জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। তবে আদালতের নির্দেশনার পর তিনি নিজেই বিষয়টি দেখছেন বলে জানান। এ দায়িত্ব তাঁর কিনা জানতে চাইলে উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান।
তবে চৌধুরী স্টোরের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন জানিয়েছেন, কিউরেটর আম্বার আলী দ্বিতীয় দরদাতাকে দিয়েই গেট ও পার্কিং এরিয়ার টাকা উত্তোলন করছেন। এতে তিনি মোটা অঙ্কের টাকার ভাগ পাচ্ছেন বলে ধারণা তাঁর।
- বিষয় :
- অনিয়মের অভিযোগ
- রংপুর