১৫ বছরে সম্পদ ৮৮৪ গুণ
স্কুলশিক্ষক থেকে কোটিপতি সাবেক এমপি হেনরী
তদন্তে দায়মুক্তি দেয় দুদক

হেনরী
আমিনুল ইসলাম খান রানা, সিরাজগঞ্জ
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:৪৪
জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছিলেন সাড়ে ৬ লাখ টাকা। স্কুলশিক্ষক হিসেবে বার্ষিক আয় ছিল সোয়া ১ লাখ টাকার মতো। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের মাত্র ১৫ বছরে সিরাজগঞ্জের সাবেক এই এমপির সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় অর্ধ শতকোটি টাকার বেশি। হলফনামার তথ্য অনুযায়ীই এ সময় তাঁর সম্পদ বেড়েছে ৮৮৪ গুণ। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করলেও অজানা কারণে দেওয়া হয় দায়মুক্তি।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর হেনরীকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার থেকে স্বামীসহ গ্রেপ্তার করা হন। এর পর তাঁর বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিয়ে ফের আলোচনা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে গত বুধবার স্বামী শামীম তালুকদার লাবুসহ তাঁকে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। তাদের গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি করে হত্যার তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া লাইসেন্স করা অস্ত্র জমা না দেওয়ায় সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে হয়েছে আলাদা মামলা। গত আগস্টে দুদকের অর্থ পাচারের মামলায়ও করা হয়েছে আসামি।
শূন্য থেকে উত্থান
সিরাজগঞ্জ সদরের সদানন্দপুরের স্কুলশিক্ষক আবদুল হামিদ মিঞার মেয়ে হেনরী ১৯৮৮ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয় জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদারের ছেলে লাবুর সঙ্গে। পরে সিরাজগঞ্জ জেলা শহরের সবুজ কানন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সহকারী শিক্ষক হন হেনরী। তবে তিনি মূলত পরিচিত পান রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে।
এ ছাড়া রাজনৈতিক পরিবারের পুত্রবধূ হওয়ায় মহিলা আওয়ামী লীগে সক্রিয় ছিলেন। এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
তাঁর কপাল খোলে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়। সিরাজগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম দুর্নীতির মামলার কারণে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় হেনরী পান নৌকা প্রতীক। নির্বাচনে অবশ্য বিএনপি প্রার্থীর কাছে হেরে যান। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করলে হেনরীকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক করা হয়। মাত্র তিন বছরেই অঢেল সম্পদের মালিক হন হেনরী। এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে দলীয় পদপদবির পাশাপাশি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে সম্পদের পরিমাণ। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বনে যান সিরাজগঞ্জের একচ্ছত্র ক্ষমতাধর নেত্রী। নিজে সংসদ সদস্য হওয়ার তিন মাসের মধ্যে ‘কয়েক কোটি টাকা’ খরচ করে স্বামী শামীম তালুকদারকে বানান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।
দু’হাতে কামিয়েছেন অর্থ ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় হেনরী সম্পদের পরিমাণ দেখান ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা। বার্ষিক আয় ১ লাখ ২২ হাজার এবং ব্যয় উল্লেখ করেন ৮০ হাজার টাকা। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে সেই হেনরীই হলফনামায় সম্পদ দেখান ৫৬ কোটি ৮ লাখ ৯৫ হাজার ৬০২ টাকা। সম্পদ বৃদ্ধির হিসাবে যা ৮৮৪ গুণ। এ ছাড়া এই ১৫ বছরে স্বামী লাবুর সম্পদ বেড়েছে ১৩৬ গুণ। ২০০৮ সালে ৭ লাখ টাকার স্থলে ২০২৪ সালে সাড়ে ৯ কোটি টাকা।
এ তো গেল সরকারি হিসাব। স্থানীয়দের অভিযোগ, গত ১৫ বছরে দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে হেনরী ৫০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন। ঠিকাদারি ও নির্মাণসামগ্রী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স লামিয়া এন্টারপ্রাইজ’সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ।
এলাকাবাসী জানান, সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়ার পর অনেকটা রাতারাতি শিল্পপতির কাতারে নাম উঠান হেনরী। যে হেনরী আগে রিকশায় চড়তেন, একলাফে উঠে যান কোটি টাকার ল্যান্ড ক্রুজারে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে নাম আসায় কিছুটা চাপে পড়েন। দুদক তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও করে। তবে ঠিকই ‘বিশেষ আশীর্বাদে’ ওই অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পান। এর পরই মূলত বেপরোয়া হয়ে ওঠেন হেনরী। ঢাকা, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে বাড়ি-গাড়িসহ একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। নিজের নামে ছাড়াও স্বামী লাবু এবং পালিত মেয়ের নামেও গড়েছেন বিপুল সম্পদ।
সিরাজগঞ্জ ও গাজীপুরে হেনরীর নামে সাইনবোর্ড দেওয়া বিপুল স্থাবর সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ সদরের নলিছাপাড়ায় হেনরী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ, পাশেই হেনরী ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্স টেকনোলজি, শহরের মুজিব সড়কে একটি দ্বিতল বাসভবন, তার পাশে ৬ তলা বিলাসবহুল বাড়ি, ওই বাড়ির বিপরীত পাশে ৯ তলা ভবনে রয়েছে অর্ধকোটি টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট। এ ছাড়া শহরের ফজল খান রোডে হেনরী স্কলাসটিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সদর উপজেলার গজারিয়ায় ‘হেনরী ভুবন’ নামে বিশাল বৃদ্ধাশ্রম, তার বিপরীত পাশে ‘কিছুক্ষণ’ নামে রিসোর্ট, এর পশ্চিমে অপটিক ফাইবার কারখানা, তার পাশে গরুর খামার, উত্তর পাশে শ্বশুর মোতাহার হোসেন তালুকদারের নামে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সদানন্দপুরে পাঁচতলা আবাসিক ভবন রয়েছে। এর বাইরে কড্ডায় একটি পেট্রোল পাম্প এবং শহরের সদর পোস্ট অফিসের বিপরীতে নির্মাণাধীন একটি বহুতল ভবন রয়েছে। সম্প্রতি সদর উপজেলার শিলন্দা গ্রামে ১০ দশমিক ১২ বিঘা অকৃষি জমি কিনেছেন প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকায়।
গাজীপুরের শ্রীপুরে বিলাসবহুল ‘রাস রিসোর্ট’ গড়েছেন হেনরী। এখানে ১৪টি আধুনিক কক্ষ, পাঁচটি প্রিমিয়াম বাংলো, আলাদা জায়গায় চারটি আর্কিটেকচারাল ডিলাক্স কটেজ ও সুইমিংপুল রয়েছে। শ্রীপুরে তাঁর রয়েছে গরুর খামার।
হেনরী ও লাবু কারাগারে থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। মুখ খোলেননি তাদের স্বজনও।
- বিষয় :
- কোটিপতি