ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

চট্টগ্রামে ডিমের বাজার

কারসাজিতে ২০ পাইকারের পকেটে কয়েক কোটি টাকা

কারসাজিতে ২০ পাইকারের পকেটে কয়েক কোটি টাকা

ছবি: ফাইল

 শৈবাল আচার্য্য, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪ | ০১:৩১

কোনো কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডিমের বাজার। উল্টো চড়ছে দাম। এক সপ্তাহ আগেও চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি ডজন ডিমের দাম বেড়ে ঠেকেছে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকায়।

যৌক্তিক কারণ ছাড়াই কারসাজি করে ডিমের দাম বাড়িয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অসাধু চক্র। যার নেপথ্যে রয়েছে চট্টগ্রামে ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা পাহাড়তলী বাজারের বৃহৎ ২০ পাইকার। ঢাকা ও টাঙ্গাইলের কিছু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে তারা ডিমের দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়ে ফায়দা লুটেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১১ টাকা ২০ থেকে ৩০ পয়সায় ডিম কিনে এসব অসাধু পাইকার বাজারে বিক্রি করেছেন প্রায় সাড়ে ১৩ টাকায়। যে কারণে খুচরা পর্যায়ে এক পিস ডিম কিনতে ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে প্রায় ১৫ টাকা। এই হিসাবে প্রতি ডিম বিক্রি বাবদ ২ টাকার বেশি ও ডজনে ১৫ থেকে ২০ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। অথচ সরকার খুচরা পর্যায়ে প্রতি পিস ডিমের দাম ১১ টাকা ৮৭ পয়সা ও প্রতি ডজন ১৪২ টাকা নির্ধারণ করেছে। ডিম নিয়ে পাইকারদের এমন কারসাজির গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যপ্রমাণ হাতে এসেছে সমকালের।

এতে দেখা গেছে, কারসাজির হোতা পাহাড়তলী বাজারের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান জান্নাত পোলট্রি। অথচ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যেতে গত তিন দিন ধরে উল্টো আড়তে ডিম কেনাবেচা বন্ধ রেখেছেন পাইকার ও আড়তদাররা।

গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বলছে, অসাধু ২০ পাইকারের মধ্যে অন্যতম পাহাড়তলী বাজারের বৃহৎ পাইকারি ডিম বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান জান্নাত পোলট্রি। এই প্রতিষ্ঠানটিই সবচেয়ে বেশি ডিম আনে চট্টগ্রামে। তাদের বড় ক্রেতা টাঙ্গাইল ও ঢাকার কয়েকটি বড় ব্যবসায়ী। চট্টগ্রামের বাজার তদারকি করে টাঙ্গাইল ও ঢাকার ব্যবসায়ীদের বাড়তি দাম বেঁধে দিয়ে ডিম সরবরাহ করতে বলে প্রতিষ্ঠানটি। কম দামে ডিম এনে তার ওপর আরও কয়েক টাকা যোগ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ৪১টি ওয়ার্ড ও জেলার ১৫ উপজেলার ছোট-বড় বাজারে ডিম সরবরাহ করে তারা। কয়েক হাতবদল হয়ে পাইকারি পর্যায়েই প্রতি পিস ডিমের দাম ১৩ টাকার ওপরে চলে যায়। খুচরা পর্যায়ে যেতে এর সঙ্গে আরও বাড়তি টাকা যোগ হয়। এভাবে কয়েক গুণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন জান্নাত পোলট্রির মতো বড় পাইকাররা। 

কম দামে ডিম কিনে তা বেশি দামে বিক্রির প্রমাণ পাওয়ায় ১৫ অক্টোবর জান্নাত পোলট্রিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে ১১ টাকার ওপরে কেনা ডিম পাইকারিতে ১৩ টাকার বেশি দামে বিক্রির প্রমাণ মিলেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। তবে বৃহৎ এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ডিম নিয়ে কারসাজি এটিই প্রথম নয়। এর আগে ৯ অক্টোবর বেশি দামে ডিম বিক্রি করায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার  প্রতিষ্ঠানটিকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করে। 

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন জান্নাত পোলট্রির মালিক দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, আমরা কারসাজি করি না। করলে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও মধ্যস্বত্বভোগীরা করে। একাধিকবার জরিমানা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জরিমানার কথা বলে লাভ কী? প্রশাসনের ইচ্ছা হয়, তাই জরিমানা করে।

জান্নাত পোলট্রির মতো আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য মিলেছে অনুসন্ধানে। এর মধ্যে রহমানিয়া দরবার শরিফ, মেসার্স এম এগ, মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স, এবিএস ট্রেডার্স, আল আমিন স্টোর, আমিন এন্টারপ্রাইজ, জনপ্রিয় স্টোর, জিলানী স্টোর, আনিকা এন্টারপ্রাইজ, আলম ব্রাদার্স, এসএম স্টোর, রাজ এন্টারপ্রাইজ, এন ট্রেডার্স উল্লেখযোগ্য। গত কয়েক দিন ধরে তারা পাইকারি পর্যায়েই প্রতি পিস ডিম বিক্রি করছে ১৩ টাকার ওপরে। পাহাড়তলী বাজারে প্রতি হাজার ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩ হাজার টাকার ওপরে। পাইকারদের এমন দামের কারণে খুচরা পর্যায়ে প্রতি পিস ডিমের দাম পড়ছে প্রায় ১৫ টাকা। নগরের বহদ্দারহাট, বক্সিরহাট, কর্ণফুলী, দেওয়ান বাজার, চকবাজারসহ প্রায় বাজারে গত কয়েক দিন ধরে এক ডজন ডিম কিনতে ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা। এলাকার অলিগলির দোকানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা। চট্টগ্রামে প্রতিদিন প্রায় ২৫ লাখ ডিমের চাহিদা রয়েছে। যার প্রায় ৮০ শতাংশই আসে টাঙ্গাইল থেকে।

গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, পাহাড়তলী বাজারের বড় আড়তদাররা টাঙ্গাইল ও ঢাকা থেকে ডিমের চাহিদার একটি বড় অংশ চট্টগ্রামে আনে। বাজারের সার্বিক খবরাখবর নিয়ে তারা কম টাকায় কেনা ডিমের ওপর বাড়তি টাকা যোগ করে। কত টাকায় ডিম কেনা ও কত টাকায় তা বিক্রি– এই দুই তথ্য গোপন করতে তারা নিজেদের কাছে কোনো কাগজপত্র রাখে না। শুধু মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিজেদের সঙ্গে কথা বলে ইচ্ছেমতো ডিমের দাম নির্ধারণ করে দেয় তারা। 

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফয়েজ উল্যাহ বলেন, এটি কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। এর পেছনে পাহাড়তলী বাজারের বড় পাইকাররা জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি আমরা। 

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, দেশের পট পরিবর্তন হলেও ভোগ্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফিরছে না। এর খেসারত দিতে হচ্ছে ভোক্তাকে। মাছ-মাংসের মতো ভরসার ডিমের দামও এখন ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। পাহাড়তলী বাজারের বড় আড়তদাররা কারসাজির সঙ্গে জড়িত জানিয়ে এরই মধ্যে আমরা একাধিকবার প্রশাসনকে অবহিতও করেছি। তবে প্রমাণ পাওয়ার পরও তাদের ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বাজার নিয়ন্ত্রণে গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব নাসরিন আক্তার বলেন, পাইকারদের কারসাজির কারণে ডিমের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। এদের ব্যাপারে আমরা মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছি।

আরও পড়ুন

×