শতকোটি টাকা লোপাটের তদন্ত প্রতিবেদন ‘ধামাচাপা’
এলজিইডির প্রকল্পে নির্বাহী প্রকৌশলীর দুর্নীতি

লোগো
আমিনুল ইসলাম খান রানা, সিরাজগঞ্জ
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪ | ২২:৩৯
নকশা ছাড়াই ভদ্রাবতী খাল খনন, মৃত ও প্রবাসে থাকা লোকজনকে শ্রমিক দেখিয়ে সরকারি টাকা লোপাট, বিধিবহির্ভূতভাবে ঠিকাদারদের বিলছাড়সহ শতকোটি টাকার অনিয়মের ঘটনায় ১৬ মাসে চারটি পৃথক তদন্ত হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণও হয়েছে। কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি প্রতিবেদন।
এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. আলী আকতার হোসেন ও সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ মহসিন নির্বাহী প্রকৌশলী সফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি। শাস্তি নয়, বরং ১ এপ্রিল থেকে জয়পুরহাটের গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন
প্রকল্পে পিডি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে প্রধান কার্যালয়ে আছেন সফিকুল ইসলাম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রকৌশলী জানান, প্রকৌশলী সফিকুল বিদায়ী প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী আলী আকতার হোসেনের ভাগনে। বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী (প্রশাসন) আবু হানিফ মৃধা তাঁর সহপাঠী। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ব্যক্তিগত সহকারী জাহিদ হোসেনের সঙ্গেও তাঁর সখ্য আছে। এসব কারণে গত দেড় বছরেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাবনার সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নাবিউল ইসলামও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে যথাসময়ে প্রতিবেদন প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে পাঠাননি। তাদের বদৌলতে তদন্ত প্রতিবেদন প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে গেলেও শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছে না বলে গুঞ্জন রয়েছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে সদ্য বিদায়ী প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী আলী আকতার হোসেন বলেন, ‘প্রকৌশলী শফিকুল ইসলামের অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে আমার কিছু করার নেই।’ একইভাবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী (প্রশাসন) আবু হানিফ মৃধা। তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে এসেছে। সেটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় পাঠানো হয়েছে। এরপরও বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে দেখব।’
রাজশাহীর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবিএম জুলফিকার আলী বলেন, ‘কাজীপুরসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছি। প্রকৌশলী শফিকুলের সময়ে সিরাজগঞ্জে যতগুলো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, সব কয়টিতেই ত্রুটি খুঁজে পাওয়া গেছে। তিনি জেলার চরম ক্ষতি করে গেছেন।’
অভিযোগ থেকে জানা গেছে, প্রকৌশলী সফিকুল তাড়াশে এলজিইডির টেকসই ক্ষুদ্রাকার পানিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে তালম-বারুহাসে ভদ্রাবতী (উত্তর-দক্ষিণ) খাল পুনর্খননে সরকারি বরাদ্দের ৩ কোটি টাকা লোপাট করেছেন। রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও কাজীপুরে আরটিআইপি প্রকল্পের বাস্তবায়িত কাজে চূড়ান্ত পরিদর্শন শেষে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর ‘প্রত্যয়ন সনদ’ ছাড়াই ঠিকাদারের ৫৭ কোটি টাকার বিল ছাড় করেছেন। তাড়াশ-বারুহাস-কুন্দইল রাস্তা এবং উল্লাপাড়া, তাড়াশ, কাজীপুর, রায়গঞ্জ ও কামারখন্দে জিওবি প্রকল্পের ঠিকাদারদেরও নিয়মবহির্ভূতভাবে ৪০ কোটি টাকার বিল দিয়েছেন।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ মহসিন ও সদ্য বিদায়ী প্রধান প্রকৌশলী আলী আকতার হোসেনের নির্দেশে গত ১৬ মাসে চারটি তদন্ত হয়। রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবিএম জুলফিকার আলী, পাবনা অঞ্চলের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নবিউল ইসলাম, এলজিইডির টেকসই ক্ষুদ্রাকার পানিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আবু সালেহ মো. হানিফ, ডিপিডি আনিসুর রহমান, পাবনার নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম তদন্ত করেন। দুদক সমন্বিত পাবনা আঞ্চলিক কার্যালয় থেকেও তদন্ত করা হয়। কিন্তু কোনো তদন্তই আলোর মুখ দেখেনি।
পাবনার সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নবিউল ইসলামের ভাষ্য, বুঝে না বুঝে তাড়াশ, উল্লাপাড়া, রায়গঞ্জ ও কাজীপুরের অন্তত ডজনখানেক প্রকৌশলী, উপসহকারী প্রকৌশলী এবং কার্যসহকারী ও ল্যাবরেটরি সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলামের ফাঁদে পা দিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। অন্তত ডজন খানেক প্রকৌশলী ও কর্মচারীও অভিযুক্ত হওয়ায় তদন্তে সময় লেগেছে বলে জানান তিনি।
কথা হলে তদন্ত কর্মকর্তা পাবনার নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম বলেন, এক বছর আগে তদন্ত প্রতিবেদন প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয় বরাবর জমা দেওয়া হয়েছে। রহস্যজনক কারণে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নবিউল ইসলাম তদন্ত প্রতিবেদন প্রধান প্রকৌশলীর কাছে জমা দেননি।
কথা বলতে সাবেক মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী জাহিদ হোসেন ও অভিযুক্ত প্রকৌশলী সফিকুলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হয়। সাড়া না পেয়ে মেসেজ পাঠানো হয়েছে।
- বিষয় :
- এলজিইডি