কর্ণফুলী টানেল: যথাযথ সমীক্ষা না করার খেসারত
টানেল করে ‘গলার ফাঁস’ চীনা ঋণ
যানবাহন চলছে লক্ষ্যমাত্রার পাঁচ ভাগের এক ভাগ

কর্ণফুলী টানেল ঘিরে আশপাশের এলাকাও হয়ে ওঠে দৃষ্টিনন্দন- মো. রাশেদ
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪ | ০১:০৩
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল পড়েছে চীনা ঋণের ফাঁদে। দেশটির ঋণের শর্ত ছিল– দরপত্র আহ্বান ছাড়াই টানেলের কাজ করবে চীনা ঠিকাদার। তাদের ঠিকাদারের মাধ্যমে এটি পরিচালনার পাশাপাশি টোলও আদায় করবে তারা। আবার টানেলের আয় যা হোক; যে ঋণ তারা দিয়েছে তা পরিশোধ করতে হবে ১৫ বছরে। আয় কম হলে সেটি ভর্তুকি দিয়ে পরিশোধ করতে হবে সেতু কর্তৃপক্ষকে। এত কঠিন শর্ত মেনে নিয়েই কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তৈরি হয় দেশের প্রথম টানেল। যথাযথভাবে সমীক্ষা না করে তৈরি হওয়া এই টানেল যাত্রার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ সোমবার। তবে বছর না ঘুরতেই এটি ‘গলার ফাঁস’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। টানেল থেকে গত এক বছরে টোল আয় হয়েছে ৩৭ কোটি টাকা। অথচ এটি রক্ষণাবেক্ষণেই খরচ হয়েছে ১৩৫ কোটি টাকা। এই আয় দিয়ে পরিশোধ করা যাবে না চীনা ঋণের টাকাও। আবার শর্ত মানতে গেলে টানেলটি বন্ধও রাখতে পারবে না সরকার।
সদ্য সাবেক হওয়া সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, ‘শুরুতে টানেলে গাড়ি চলাচল কম থাকবে। ধীরে ধীরে এটি বাড়বে– এমনই বলা ছিল সমীক্ষায়। কক্সবাজারের মাতারবাড়ী ও মিরসরাইয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলকে টানেলের সঙ্গে দ্রুত যুক্ত করা গেলে এটির ব্যবহার আরও বাড়বে। এটি নিয়ে কাজ চলছে। আর চীনা ঋণের কিস্তি কীভাবে পরিশোধ করা হবে তা দেখছে অর্থ মন্ত্রণালয়।’ চীনের সব শর্ত মেনে নেওয়ায় টানেল নির্মাণে খরচ বেড়েছে কিনা– তা নিয়ে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. সামছুল হক বলেন, ‘চীনের শর্ত মানতে গিয়ে প্রতিযোগিতামূলক দর নিতে পারেনি তখনকার সরকার। এ জন্য টানেল নির্মাণে অনেক বেশি অর্থ খরচ হয়েছে। এর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন খরচও অনেক বেড়ে গেছে। এটি না করে কর্ণফুলী নদীতে যদি ঝুলন্ত সেতু করা হতো, তাহলে অনেক কম টাকা খরচ হতো।’
সমীক্ষাও হয়নি যথাযথ
শুরুতে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের খরচ ধরা হয় ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয় চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে। বিদেশি ঋণ নিয়ে প্রকল্পটি নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের আগে যথাযথভাবে করা হয়নি সমীক্ষাও। টানেল দিয়ে এখন দিনে গড়ে ৩ হাজার ৯১০টি যানবাহন চলছে। সমীক্ষা প্রতিবেদন বলেছিল, গড়ে ১৮ হাজার ৪৮৫টি যানবাহন চলাচল করবে। এই টানেলের সমীক্ষা প্রতিবেদনও দিয়েছে চীনা ঠিকাদার। সমীক্ষায় তারা উল্লেখ করে, টানেল চালু হলে ২০২০ সালে দিনে ২০ হাজার ৭১৯টি গাড়ি চলবে। প্রতিবছর তা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে। ২০২৫ সালে দৈনিক গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলবে। ২০৩০ সালে সংখ্যাটি দাঁড়াবে দিনে প্রায় ৩৮ হাজারে। কিন্তু এই সমীক্ষার ধারেকাছেও নেই বাস্তব চিত্র।
বছরে ৩৭ কোটি আয়, ১৩৫ কোটি ব্যয়
সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাবে টানেল থেকে টোল বাবদ দৈনিক গড়ে আয় হচ্ছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। তবে টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ দিনে খরচ হচ্ছে গড়ে সাড়ে ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। গত এক বছরে টানেলে আয় হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ১৩৫ কোটি ২৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে খরচ সাড়ে তিন গুণ বেশি। এক বছরে টানেলে গাড়ি চলাচল করেছে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি। টানেল পার হওয়া যানবাহনের মধ্যে ৭৬ দশমিক ৭৫ শতাংশই হালকা যান। এর মধ্যে বাস ১০ শতাংশ, ট্রাক ১২ দশমিক ৪ শতাংশ এবং লরি দশমিক ৮৫ শতাংশ। ভারী যানবাহন কম চলার কারণে টানেল থেকে টোল আদায়ও কম হচ্ছে।
নির্মাণ খরচ ভেঙেছে সব রেকর্ড
চীনের দীর্ঘতম হাইওয়ে টানেল টাইহু টানেল নির্মাণ শুরু হয় ২০১৮ সালে। প্রায় ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই টানেলটি চালু হয় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, টানেলটি নির্মাণে বাংলাদেশি মুদ্রায় কিলোমিটারপ্রতি খরচ দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। ভারতের মুম্বাইয়ে মুম্বাই কোস্টাল রোড প্রকল্পের আওতায় সমুদ্রের তলদেশে দুই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশের টানেল নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারের খরচ হয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি!
৫ বছরে চীনকে দিতে হবে ৯৮৪ কোটি টাকা
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) টানেলটি নির্মাণ করেছে। টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজও পেয়েছে তারা। এ জন্য তাদের দিতে হবে ৯৮৪ কোটি টাকা (৩৫ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রায়)। এই টানেলের জন্য চীনা ঋণের সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ শতাংশ। এর সঙ্গে আছে শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ সেবা মাশুল। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ১৫ বছর। এর মধ্যে ঋণ নেওয়া ও কিস্তি শোধ শুরুর মধ্যকার বিরতি (গ্রেস পিরিয়ড) হিসেবে পাঁচ বছর সময় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাধারণত প্রথম কিস্তি পাওয়ার পরের পাঁচ বছরকে গ্রেস পিরিয়ড ধরা হয়। এ ছাড়া প্রতি পাঁচ বছর পর একবার টানেলের বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, যাকে বলা হয় ‘রেগুলার মেইনটেন্যান্স’। এ ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে প্রতিবার প্রায় ১৯ লাখ ডলার (২২ কোটি টাকা) খরচ করতে হবে।
ঋণের কিস্তি শুরু হবে এ বছরই
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ঠিকাদারকে দেওয়া ৯৮৪ কোটি টাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে স্ক্যানার কেনার টাকাও। এটি কিনতে ব্যয় হয়েছিল ৩০০ কোটি টাকা। এটি বাদ দিলে রক্ষণাবেক্ষণে পাঁচ বছরে প্রকৃত খরচ ৬৮৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে রক্ষণাবেক্ষণের দৈনিক ব্যয় দাঁড়ায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। তবে টোল থেকে এখন যে টাকা আয় হচ্ছে, তা এই রক্ষণাবেক্ষণ খরচের তিন ভাগের এক ভাগ! অথচ এ বছর থেকেই টানেলের জন্য নেওয়া চীনা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। আয় কম হলেও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রয়োজনে অন্য কোনো সেতুর আয় থেকে পরিশোধ করতে হবে সরকারকে।
কাজ হয়নি পরিকল্পনা অনুযায়ী
টানেলটির মূল দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২০১৫ সালের নভেম্বরে এই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। কিন্তু টানেল চালু হয়েছে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর। টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। তখন বলা হয়েছিল, কক্সবাজার ও মাতারবাড়ীকে টানেলের সঙ্গে দ্রুত যুক্ত করা হবে। মিরেরসরাইয়ের অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গেও সংযোগ হবে টানেলের। যুক্ত হবে চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল প্রকল্পও। তবে এসবের কোনোটিই হয়নি বাস্তবে।
প্রশস্ত হয়নি সংযোগ সড়কও
চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা প্রান্ত হয়ে টানেলের সংযোগ সড়কে যুক্ত হয়েছে পিএবি সড়কে। টানেলের সঙ্গে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে সড়ককে যুক্ত করতে আনোয়ারার কালাবিবির দিঘির মোড় থেকে কর্ণফুলীর শিকলবাহা ওয়াই জংশন (ক্রসিং) পর্যন্ত সড়কটি ছয় লেনে উন্নিত করার প্রকল্প নেয় সওজ। তবে টানেল উদ্বোধনের এক বছর হয়ে গেলেও এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি ছয় লেন সড়কের কাজ। এ জন্য এই পয়েন্টে প্রতিনিয়ত হচ্ছে যানজট। আবার টানেল হয়ে ঢাকা-কক্সবাজারের গাড়ি চলাচলের জন্য বিকল্প সড়ক হিসেবে আনোয়ারা প্রান্তের চাতুরী চৌমুহনী বাজার এলাকায় টানেল চত্বর থেকে কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া এলাকায় সংযুক্ত করার জন্য বাইপাস সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল দোহাজারী সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এই বাইপাস সড়ক নির্মাণের কাজেও নেই অগ্রগতি। অথচ এই বাইপাস সড়ক নির্মাণ হলে ঢাকা-কক্সবাজারের দূরত্ব অনেকাংশ কমে যেত।
- বিষয় :
- কর্ণফুলী