‘হামার ফির আকাল শুরু হইচে’
রংপুর অঞ্চলে শ্রমজীবী মানুষের দুর্দিন

কাজ না পাওয়ায় হতাশ শ্রমজীবীরা। রংপুর নগরীর শিমুলবাগে শ্রমিকের হাট থেকে তোলা -সমকাল
স্বপন চৌধুরী, রংপুর
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:২৪ | আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৪ | ১১:৩০
‘কী করি বাহে, হামার ফির কাতি (কার্তিক) মাসের আকাল শুরু হইচে। ঘরোত এ্যাকনা দানা-পানিও নাই। কাম-কাজও মেলে না। তাতে জিনিসপত্রের যে দাম, হামারগুলার তো বুজি আর জানে (জীবন) বাঁচে না।’ এসব বলছিলেন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার শংকরদহ চরের ষাটোর্ধ্ব নুর মোহাম্মদ।
সাম্প্রতিক বন্যার ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি তিস্তাপারের মানুষ। রোপা আমন ধান কাটা ও মাড়াই শুরু না হওয়া পর্যন্ত এলাকায় কাজও মিলবে না। চলতি বছর অতিদরিদ্র মানুষের জন্য সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির কোনো বরাদ্দ আসেনি। এতে রংপুর অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষ পড়েছেন চরম বেকায়দায়।
সাধারণত এ সময় তেমন কাজ না থাকায় এ অঞ্চলের কৃষি শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েন। রংপুর জেলায় কৃষি শ্রমিক প্রায় দুই লাখ। বিশেষ করে তিস্তার চরাঞ্চলসহ গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও তারাগঞ্জ এলাকার কৃষি শ্রমিকরা বছরের এই সময়ে কাজের সন্ধানে ছুটে যান দেশের নানা স্থানে। সকালে অনেকেই দলবেঁধে কাজ পাওয়ার আশায় শহরে যান। প্রত্যেকের বাইসাইকেলের পেছনে বাঁধা থাকে ডালি, কাস্তে, কোদাল, দা, খন্তাসহ কাজের বিভিন্ন উপকরণ। শ্রমিকের হাট বলে পরিচিত রংপুর শহরের শিমুলবাগ, জামতলা মোড়, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, বেতপট্টি কিংবা রেলওয়ে স্টেশনে বসে থাকেন তারা। কাজ না মিললে নিরাশ হয়ে বাড়ি ফেরেন।
সকাল ৮টায় শ্রমিকের হাট বলে পরিচিত রংপুর নগরীর শিমুলবাগে কাজ পাওয়ার আশায় বসেছিলেন শংকরদহ চরের নুর মোহাম্মদসহ কয়েকজন। চোখেমুখে তাদের হতাশার ছাপ। গঙ্গাচড়ার ছালাপাক চরের আজমল হোসেন বলেন, ‘প্রত্যেকদিন বিয়ানে (সকালে) আল্লার নামে বাড়ি থাকি বেরাই, যদি কাম জোটে। ছাওয়াগুলার (সন্তানদের) মুখোত খাওন দেওয়া নাগবে তো! কিন্তুক এক দিন কাম (কাজ) জোটে তো তিন দিন খালি হাতে নিরাশ হয়্যা ফিরি যাওয়া নাগে।’
বাইসাইকেল চালিয়ে কাজের নানা উপকরণসহ হাটে এসেছেন শংকরদহ চরের আব্দুল হামিদ (৬৫)। তিনি বলেন, ‘কাইল থাকি বউ-ছাওয়া নিয়া কষ্টে আছি। সকালে খালি এক গ্লাস পানি খ্যায়া আচ্চু। কাম জুটলে খরচ করি বাড়িত যাইম, না জুটলে আইজও না খ্যায়া থাকা নাগবে।’
একই এলাকার নওশা মিয়া, ওমর আলী ও নয়া মিয়া জানান, কয়েক বছর ধরে এই সময়ে তারা বগুড়া, সিলেট, ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে আগাম ধান কাটা, মাড়াইসহ বিভিন্ন কাজ করে ছয় থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন। কিন্তু এবার ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে অস্থিতিশীলতাসহ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে ভয়ে তারা বাইরের জেলায় যাননি। এলাকাতেও কাজের সুযোগ না থাকায় পরিবার নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। বেলা বাড়ায় ধীরে ধীরে অন্তত ৩০ জন কাজের সন্ধানে জড়ো হন শিমুলবাগ এলাকায়।
তাদের কেউ কেউ জানান, কাজ জুটলে ৫০০ টাকা হাজিরা পাওয়া যায়। বাসাবাড়িতে মাটি কাটা, বালু ফেলা কিংবা ঘরের খুঁটি লাগানোর কাজ করেন। কখনও দল বেঁধে চুক্তিতে, আবার কখনও বা একাই সারাদিনের জন্য শ্রম বিক্রি করেন। তবে বর্তমানে দিন খারাপ যাচ্ছে। সপ্তাহে তিন দিনের বেশি কাজ কারও মিলছে না।
দুপুরে শংকরদহ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, তিস্তার ভাঙনে বিধ্বস্ত-বিরানভূমিতে অনেক এলাকা। রংপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে তিস্তা সেতু পার হয়ে পশ্চিম দিকে গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নে এই গ্রাম। পরিবারের প্রধানরা বাড়িতে নেই। কাজের সন্ধানে বিভিন্ন এলাকায় ছুটে গেছেন তারা। আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় তাদের খাবারের সংস্থান করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য রমজান আলী জানান, চরের ৪০০ পরিবারের মধ্যে নদীভাঙনে অর্ধেকই অন্যত্র চলে গেছেন। বাকি ২০০ পরিবারের সবাই শ্রম বিক্রি করেন। তিন দিন আগে কাজের সন্ধানে বগুড়ায় গেছেন আব্দুল ওয়াহাব।
তাঁর স্ত্রী মনিরা বেগম বলেন, ‘বাড়িত থাকি কী করে, গ্রামোত (গ্রামে) যে কাম নাই। ধানের কাটা-মাড়াই শুরু হইলে ওমরা (স্বামী) বাড়িত আসপে।’ মনছুর আলীর স্ত্রী সোনাভান বলেন, ‘সারাদিন ছাওয়াগুলা কিছুই খায় নাই। সকালে ওমরা শহরোত গেইচে। কাম জুটলে খরচ করি আনবে। তখন আন্দাবাড়ি (রান্না) হইবে।’
তিস্তার চরে প্রাকৃতিকভাবে গজিয়ে ওঠা ঘাস উঠিয়ে সাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন ওমর আলী। তিনি জানান, এলাকায় কাজ না পাওয়ায় প্রতিদিন ঘাস তুলে বাজারে বিক্রি করেন। ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হয়, তাই দিয়ে কষ্টে সংসার চালান। এমন জীবন সংগ্রাম এখন বৃহত্তর রংপুরের পাঁচ জেলার নিম্ন আয়ের মানুষের।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদ তামান্না এ প্রসঙ্গে বলেন, এই সময়ে শ্রমজীবীদের দুর্দিন থাকে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিবছর কাবিখা, কাবিটাসহ অতিদরিদ্রদের জন্য ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচি চালু থাকে। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এই বরাদ্দ আসার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত আসেনি। তবে বরাদ্দ আসবে বলে জানান তিনি। একই তথ্য জানান জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন।
উন্নয়ন গবেষকরা বলছেন, প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে কর্মহীন হয়ে পড়ায় খাদ্য সংকটে পড়তে হয় নিম্ন আয়ের মানুষকে। প্রতিবছর সরকারের পক্ষ থেকে এ সংকট মোকাবিলায় অতিদরিদ্রদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত তেমন উদ্যোগ না থাকায় খুবই কষ্টে আছে রংপুর অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষ।
রংপুরের উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, কর্মহীন মানুষকে মূল স্রোতধারায় আনতে না পারলে দেশের দারিদ্র্য মানচিত্রে বড় ক্ষতি হবে। কৃষিনির্ভর এই এলাকায় কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপন করে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন তিনি।
- বিষয় :
- শ্রমজীবী