সুন্দরবনে দস্যু উৎপাতের শঙ্কা

সুন্দরবনের দুবলার চরে শুঁটকি তৈরির জন্য মাছ আহরণে যেতে মোংলা ফেরিঘাট এলাকায় নৌকা নিয়ে রওনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জেলেরা সমকাল
মনিরুল হায়দার ইকবাল, মোংলা (বাগেরহাট)
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪ | ২২:৫১
সুন্দরবনসংলগ্ন সাগর উপকূলে শুরু হয়েছে সামুদ্রিক মাছ আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ মৌসুম। গত সোমবার থেকে পাঁচ মাসব্যাপী এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন উপকূলে দুবলার চর এখন হাজার হাজার মৎস্যজীবীর পদচারণায় মুখর। মৌসুমের শুরুতে চরে বসতি ও নানা স্থাপনা তৈরিতে ব্যস্ত তারা। কেউ কেউ মাছ ধরারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে সুন্দরবনে সম্প্রতি দস্যুদের উৎপাত শুরু হওয়ায় জেলেদের মধ্যে উদ্বেগও রয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের পাঁচটি চর নিয়ে সুন্দরবনে সবচেয়ে বড় মৎস্যকেন্দ্র দুবলার শুঁটকিপল্লি। মাথায় বড় ঋণের বোঝা নিয়ে মৎস্যজীবীরা এসব চরে শুঁটকি তৈরি করতে এসেছেন। শুঁটকি আহরণে মোংলার চিলা খাল থেকে রওনা দেওয়া সাতক্ষীরার জেলে শুভঙ্কর হালদার ও শরজিৎ বিশ্বাস বলছিলেন, ২০ লাখ টাকা ঋণ করে সমুদ্রে মাছ আহরণে এসেছেন তারা। কী হবে জানেন না। তাদের সংসার চলে মাছ আহরণ ও শুঁটকি তৈরি করে।
জেলেদের ভাষ্য, তারা প্রতি বছর বিভিন্নভাবে ঋণ করে সমুদ্রে যান। সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা পান না। মন্ত্রী ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা সমস্যার কথা শুনে সমাধানের আশ্বাস দেন। তবে আজও তারা আশ্বাসের বাস্তবায়ন দেখেননি। বছরের পাঁচ মাস সাগরের নোনাপানি আর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে লড়াই করে মাছ ধরবেন। তারপর রোদে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করতে হবে। তাদের মতো ৯০ শতাংশ জেলে বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সমুদ্রে যাচ্ছেন বলেও জানান তারা।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ আহরণ করলেও নানা প্রতিকূলতায় ভাগ্যের চাকা ঘোরে না উপকূলের জেলে পরিবারগুলোর। দিন দিন তাদের অবস্থার অবনতি হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান ক্ষতির মুখে পুঁজি ও জাল-নৌকা হারিয়ে পেশা বদলেছেন অনেকে। আবার অনেকে চড়াহারে মহাজনদের সুদের মাশুল গুণে এ পেশায় টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছেন বলে মৎস্যজীবীরা জানিয়েছেন।
জানা গেছে– চট্টগ্রাম, খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরা, বরগুনার পাথরঘাটা, পিরোজপুর, বাগেরহাটের শরণখোলা, রামপাল, মোংলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে জেলেরা দুবলার চরে জড়ো হয়েছেন। শুঁটকি তৈরির জন্য আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সাগরের এ ছোট চরে থাকবে তাদের ব্যস্ততা। দুবলার চর, আলোরকোল, মাঝেরকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া ও শ্যালারচরে মৌসুমের পাঁচ মাস চলবে শুঁটকি উৎপাদন প্রক্রিয়া।
এ বছর শুঁটকি আহরণ মৌসুমে পাঁচটি চরে এক হাজার ১০৮টি জেলে ঘর, ৭৮টি ডিপো ও শতাধিক দোকান তৈরির অনুমতি দিয়েছে বন বিভাগ। দুবলার চরকেন্দ্রিক গত বছরের শুঁটকি মৌসুমে রাজস্ব আদায় হয়েছিল প্রায় ৭ কোটি টাকা। এ বছর ৮ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার শুঁটকি উৎপাদন বাড়বে বলে বন বিভাগের প্রত্যাশা।
বন বিভাগের একটি সূত্র জানায়, শুঁটকি মৌসুমে জেলেরা অন্তত ১৫ হাজার টন সামুদ্রিক মাছ, চার হাজার টন চিংড়ি ও শিলা কাঁকড়া আহরণ করবেন। রুপালি ইলিশ শিকার করবেন প্রায় ৮০০ টন। এবার রাজস্ব আয় আগের হিসাব ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
এরইমধ্যে দস্যুদের উৎপাতের বিষয়ে জেলে রহিম জমাদার, মোখলেসুর রহমান ও সেলিম আকন জানান, গত চার-পাঁচ বছর দস্যুদের উৎপাত ছিল না। তবে এবার শুনেছেন, জলদস্যুরা নাকি সাগরে নেমেছেন। সামনের দিনগুলোতে বিষয়টি বোঝা যাবে। তবে দস্যুরা সাগরে নামলে তাদের সর্বনাশ হবে। এজন্য কোস্টগার্ডের নিরাপত্তা চান তারা।
জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি অবৈধ জালে কেউ যেন মাছ ধরতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের কর্মকর্তা কমান্ডার রাশেদুল করিম। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী নুরুল করিম বলেন, দুবলার পাঁচটি চরে টানা পাঁচ মাস অবস্থান করবেন ১০ হাজারের বেশি জেলে। তবে বেসরকারি হিসাব মতে, এর সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে।
বন বিভাগের দুবলার চর জেলেপল্লি টহল ফাঁড়ির ইনচার্জ ফরেস্ট রেঞ্জার মো. খলিলুর রহমানের ভাষ্য, মা ইলিশ সংরক্ষণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় সোমবার সুন্দরবনে শুরু হয়েছে শুঁটকি আহরণ মৌসুম, চলবে আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত। শুঁটকি আহরণ মৌসুমে জেলেরা অস্থায়ী থাকার ঘর, মাছ শুকানোর চাতাল ও মাচা তৈরি করেন। এ বছর শুঁটকি আহরণ থেকে প্রায় ৮ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হবে বলে আশা তাঁর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনকে রক্ষা না করলে ভবিষ্যতে এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ ভয়াবহভাবে বিপন্ন হতে পারে। এজন্য বনের বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম রক্ষায় সরকারি-বেসরকারিভাবে সমান উদ্যোগ গ্রহণ করে এগিয়ে আসতে হবে। জেলেরা যাতে বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে শুঁটকির জন্য মাছ আহরণ করতে পারেন, সেজন্য বন বিভাগের ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘সুন্দরবন আমাদের প্রকৃতিক রক্ষাকবজ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে দীর্ঘদিন ধরে মায়ের মতো আগলে রেখেছে। লোভের বলি হয়ে গুরুতর বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ বন।’
- বিষয় :
- মাছ ধরা