রেলের তেল চুরিতে হাবিলদার-সিপাহি

ফাইল ছবি
তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:৫১ | আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪ | ১০:১৪
এক হাবিলদার, তিন সিপাহি– চট্টগ্রাম রেলওয়ের তেল চুরি গল্পের কুশীলব। বেশ পরিপাটি এক নাটকের মঞ্চায়নও করেছিলেন তারা। বিধি বাম! সিসি ক্যামেরায় খেলেন ধরা। সেদিন ছিল ২৬ অক্টোবর। ভোরের আলো ফুটছে কেবল। আলো-আঁধারিতে চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ডের (সিজিপিওয়াই) একটি ওয়াগন থেকে গ্যালনে গ্যালনে তেল চুরিতে লেগে পড়েন ওরা চারজন। তেল নিয়ে মজুত করছেন পাশের ঝোপঝাড়ে। ফুটেজে পরিষ্কার চারজনের মুখ। সেখানে দেখা যায়, ঘরের ইঁদুরই কাটছে বেড়া!
এর মধ্যে একজন রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সিপাহি মাহমুদুল হাসান। তিনি সিজিপিওয়াইতে কাটিয়েছেন ৯ বছরেরও বেশি সময়। এর পর ২০২২ সালের মার্চে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদরদপ্তর চট্টগ্রামের সিআরবিতে বদলি করা হয় তাঁকে। মাহমুদুলের সঙ্গে সেই সময় বদলি করা হয়েছিল সিজিপিওয়াইয়ে ১৪ বছর চাকরি করা আরেক সিপাহি শহীদুল ইসলামকেও। তবে দু’জনকে সিআরবিতে থাকতে হয়নি বেশিদিন। চেষ্টা-তদবিরে বছর না পেরোতেই দুই সিপাহি সিজিপিওয়াইতে ফেরেন বীরদর্পে। সেখানে ফিরেই তেল চুরির পুরোনো নেশায় মাতেন। চার চোরের বাকি দু’জন ছিলেন রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য হাবিলদার আমিনুল হক ও সিপাহি মো. কাউসার।
এই তেল চুরির ঘটনা চাউর হলে বিষয়টি অন্যের ঘাড়ে চাপাতে তারা নেন অভিনব এক কৌশল। কর্মস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম নগরীর সল্টগোলা এলাকায় একটি ওয়াগন থেকে তেল চুরির সময় দুই চোরকে ধরার নাটক সাজায় এই চক্র। এর পর তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিতে বাহিনীরই তিন সদস্যসহ পাঁচজনের নাম পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়। নাটকের এখানেই শেষ নয়, বিষয়টি রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে সরাসরি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে খুদে বার্তা পাঠান চক্রের সিপাহি মাহমুদুল! সেই বার্তা রেলের কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছামাত্র আরএনবির সেই তিনজনসহ ১২ জনকে তাৎক্ষণিক সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে গঠন হয় তদন্ত কমিটি। তবে সেই তদন্তে বেরিয়ে আসে ‘ঘরের ইঁদুর’। প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা অভিযোগকারী, তারাই আসল চোর।
২৬ অক্টোবর পর্যন্ত সিজিপিওয়াই থেকে সংগ্রহ করা এক মাসের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেই এক মাসে একই কায়দায় ১৬ দফা তেল চুরি করেন নিরাপত্তা বাহিনীর এই সদস্যরা। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় ছিলেন আরও কয়েকজন। আরএনবির কাজই হচ্ছে রেলসম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় সদস্য, রেলের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বহিরাগত মিলেমিশে তেল পাচারের পাশাপাশি ট্রেনের মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি করছেন। বিশেষ করে এসব ঘটনায় জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা একই কর্মস্থলে ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত কর্মরত থাকার সুযোগে অবৈধ আয়ের পথ তৈরি করে নিয়েছেন। তাদের রয়েছে সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র।
তেল চুরির ১৬ ফুটেজ
সিজিপিওয়াইতে তেলের ওয়াগন থেকে প্রায় সময় তেল চুরি ও পাচারের ঘটনা ঘটছে। আরএনবির হাবিলদার আমিনুল হক, সিপাহি মাহমুদুল হাসান, শহীদুল ইসলাম ও মো. কাউসারই এই চক্রের অন্যতম সদস্য। শুধু সিজিপিওয়াইয়ে ইয়ার্ড মাস্টার কার্যালয়ের পাশে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা গেছে, ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত এক মাসে তেলের ওয়াগন থেকে অন্তত ১৬ দফা তেল চুরির ঘটনা ঘটে। প্রতিবারই আরএনবির এই চার সদস্য অপকর্মে ছিলেন। সমকালের হাতে এসেছে এসব সিসিটিভি ফুটেজ। তাতে দেখা যায়, ওয়াগনের ওপরের মুখ খুলে গ্যালনে করে তেল চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়। সর্বশেষ গত ২৬ অক্টোবর ভোর ৫টা ২০ মিনিটে একটি ওয়াগন থেকে ওই চারজনকে তেল চুরি করে পাশের ঝোপঝাড়ে নিয়ে যেতে দেখা যায়। পরদিন ২৭ অক্টোবর সিসিটিভি ফুটেজে চুরির দৃশ্য দেখে চোখ কপালে ওঠে ইয়ার্ড মাস্টারের। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে তিনি সিজিপিওয়াইয়ের ইন্সপেক্টর আবু সুফিয়ানকে লিখিতভাবে জানান। এর পরই বিষয়টি জানাজানি হয়।
আরএনবির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গত ২৬ অক্টোবর যে ওয়াগন থেকে তেল চুরির ঘটনা ঘটে, সেটির দায়িত্বে ছিলেন আরএনবি চট্টগ্রাম গোয়েন্দা শাখার সিপাহি মকসুদ ও নজরুল কবির। তেল চুরির ঘটনায় তারাও জড়িত ছিলেন। বিষয়টি গোয়েন্দা শাখার ইন্সপেক্টর ইয়াসিন জানতেন। তবে অদৃশ্য কারণে তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি।
সিপাহির অভিযোগ উপদেষ্টার হোয়াটসঅ্যাপে
অন্তর্বর্তী সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। একই এলাকায় বাড়ি আরএনবির সিপাহি মাহমুদুলেরও। এই সূত্রে গত ২৮ অক্টোবর তিনি উপদেষ্টার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একটি অভিযোগপত্র পাঠান। তাতে লেখা হয়, ‘২৭ অক্টোবর রাত সাড়ে ৩টার দিকে ডিউটি শেষে তিনি ছাড়াও হাবিলদার আমিনুল হক, সিপাহি শহীদুল ইসলাম ও মো. কাউসার চা-নাশতা খেতে সল্টগোলা এলাকায় যান। সেখানে অবস্থান করা একটি তেলের ওয়াগন থেকে তেল চুরি হচ্ছে বলে তাদের সন্দেহ হয়। এ সময় তারা দুজনকে হাতেনাতে ধরেন। জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরএনবির সিজিপিওয়াইয়ের পোস্টিং হাবিলদার জসিম উদ্দিন, নায়েক মো. ইয়াসিন, সিপাহি বাবলু, সিজিপিওয়াই ইয়ার্ড মাস্টার আবদুল মালেক, নিউমুরিং ইয়ার্ড ইনচার্জ মৃণাল কান্তি দাশ ও পয়েন্টসম্যান আবু তাহেরের হয়ে তারা তেল চুরি করেন বলে জানান। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ওই দুই ব্যক্তির লোকজন হামলা করে তাদের ছিনিয়ে নিয়ে যান। হামলায় মাহমুদুল হাসান আহত হন বলে দাবি করা হয়।’ হোয়াটসঅ্যাপ বার্তাটি উপদেষ্টা রেলের সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পাঠান। আর এই বার্তার ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই ছাড়া রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামের বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের নির্দেশে আরএনবির চট্টগ্রামের কমান্ড্যান্ট মো. শহীদ উল্লাহ এক আদেশে আরএনবির তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। এ ছাড়া আলাদা এক আদেশে ট্রেন চালক, সহকারী চালকসহ ৯ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সাজানো নাটক
তথ্যপ্রমাণে দেখা যায়, হাবিলদার আমিনুল, সিপাহি মাহমুদুল, শহীদুল ও কাউসারই হচ্ছে আসল তেল পাচারকারী ও চোর চক্রের সদস্য। এক পর্যায়ে তারা বিষয়টি স্বীকারও করেন। তবে তারা এ ঘটনা থেকে নিস্তার পেতে পরিকল্পিতভাবে নাটক সাজান। সিজিপিওয়াই থেকে সল্টগোলার দূরত্ব চার কিলোমিটার। ২৭ অক্টোবর ডিউটি শেষে এতদূরে রাত সাড়ে ৩টায় নাশতা খেতে যাওয়ার বিষয়টি প্রশ্নের জন্ম দেয়। তাছাড়া কোনো ধরনের অভিযান চালাতে হলে কর্মস্থলে জিডি করে যেতে হয়। আবার কর্মস্থলের ব্যারাক ছেড়ে যেতে হলেও জানাতে হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। তবে এর কোনোটিই করেননি তারা। মূলত তেল চুরির বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় অন্যদের ফাঁসিয়ে নিজেরা পার পাওয়ার চেষ্টা করেন তারা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।
উল্টো ফাঁসলেন
রেলপথ উপদেষ্টার বার্তা পাওয়ার পরপরই অভিযুক্তদের মধ্যে পাঁচজনকে সাময়িক বরখাস্ত করার পাশাপাশি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামের সহকারী ট্রাফিক অফিসার মো. মনিরুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত সোমবার তারা যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তাতে বলা হয়, আরএনবির হাবিলদার আমিনুল হক, সিপাহি মাহমুদুল হাসান, শহীদুল ইসলাম ও মো. কাউসার খারাপ উদ্দেশ্যে কর্মস্থলের বাইরে সল্টগোলা গিয়েছিলেন। এতে হিতে বিপরীত হওয়ায় তারা নাটক সাজিয়েছিলেন। তবে তাদের সেই নাটক কাজে দেয়নি।
তদন্ত দলের প্রধান রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামের সহকারী ট্রাফিক অফিসার মো. মনিরুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘প্রত্যেক কিছুর একটা চেইন অব কমান্ড আছে। আরএনবির হাবিলদার একটি অভিযোগ তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে না জানিয়ে সরাসরি সরকারের রেলপথ উপদেষ্টার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে লিখিত আকারে জানিয়েছেন। এটা শিষ্টাচারবহির্ভূত। আবার তেল চুরির কাণ্ড ঘটিয়ে নিজেরা বাঁচতে কয়েকজন নিরপরাধ সহকর্মীকে ফাঁসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তদন্তে এসব সত্য বেরিয়ে এসেছে। আসল অপরাধী ওই চারজনই। কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।’
শাস্তি হয়নি, তাই বাড়বাড়ন্ত
২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর সিজিপিওয়াইয়ের তখনকার আরএনবি ইন্সপেক্টর আমানত উল্লাহ আমান বাহিনীর বিভিন্ন পদের ১০ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি লেখেন বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্টের কাছে। এতে তাদের বিরুদ্ধে তেল ও রেলের মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরিসহ বিভিন্ন কুকীর্তি তুলে ধরা হয়। যাতে নাম ছিল সিপাহি মাহমুদুল হাসান ও শহীদুল ইসলামের। তবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো পুরোনো কর্মস্থলে ফিরে একই কায়দায় ওয়াগন থেকে তেল ও ট্রেনের মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরিতে নামেন তারা।
কারা কী বলছেন
আরএনবি চট্টগ্রামের কমান্ড্যান্ট মো. শহীদ উল্লাহ সমকালকে বলেন, ‘কয়েকজন সদস্যের কারণে বাহিনীর দুর্নাম হচ্ছে। তেল চুরির যে ঘটনা ঘটেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে তদন্তে সত্য বেরিয়ে এসেছে। যারা নিরপরাধ, তাদের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আসল অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
এ ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘তেল কেলেঙ্কারি তদন্তে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাদের প্রতিবেদন এখনও আমি হাতে পাইনি। তবে নিজেরাই অপরাধ করে অন্য কাউকে ফাঁসানোর বিষয়টি যদি সত্য হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’