ভবদহ পরিদর্শনে উপদেষ্টা রিজওয়ানা
জলাবদ্ধতা নিরসনে পরামর্শ নেওয়া হবে স্থানীয়দের

টেকা নদের খননকাজ পরিদর্শনে রোববার উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সমকাল
যশোর অফিস ও নওয়াপাড়া প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:০২
যশোরের দুঃখ ভবদহ অঞ্চলের প্রায় চার লাখ মানুষ এখনও পানিবন্দি। গত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দফায় দফায় বৃষ্টি, ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং হরিহর, শ্রীহরি, মুক্তেশ্বরী, টেকা ও ভদ্রা নদীর উপচে পড়া পানিতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। কেশবপুর, মনিরামপুর, অভয়নগরের শতাধিক গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ তিন মাস ধরে পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন চর্ম ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল রোববার জলাবদ্ধ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। অভয়নগরের আমডাঙ্গা খাল, সুন্দলী, বিল কপালিয়া, ভবদহ স্লুইসগেট এলাকা পরিদর্শন করে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
উপদেষ্টা যেখানে গেছেন, সেখানেই জলমগ্ন হয়ে ভোগান্তিতে থাকা মানুষ দীর্ঘদিনের দাবি নিয়ে বিভিন্ন বিলবোর্ড ও ব্যানার হাতে অবস্থান নেন। তারা দ্রুত সমস্যা নিরসনের পাশাপাশি বিগত সময়ে এ প্রকল্পের অর্থ লুটপাটকারীদের শাস্তির দাবি জানান।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, এতদিন জনপ্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরামর্শে ভবদহ সমস্যা সমাধানে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এবার স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের পরামর্শ নিয়ে স্থায়ী সমাধান করা হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কিংবা অন্য কোনো সংস্থা এবার নিজের মত চাপিয়ে দেবে না। জনগণের মতামত নিয়ে পরিকল্পনা ও সেটি বাস্তবায়ন করা হবে।
উপদেষ্টা বলেন, ভবদহ নিয়ে অনেক প্রকল্প হয়েছে, সমস্যা কেন বারবার ফিরে আসে, সেটা বিশ্লেষণ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভবদহ সমস্যা সমাধানে ভুক্তভোগী জনগণের চাওয়ার ভিত্তিতে আমডাঙ্গা খাল প্রশস্ত ও এই এলাকার নদনদী খনন করা হবে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মুহাম্মদ আমিরুল হক ভূঞা, যশোরে জেলা প্রশাসক আজহারুল ইসলাম প্রমুখ।
যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। পলি পড়ে এই অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রীহরি নদী নাব্য হারিয়েছে।
সরেজমিন এই অঞ্চলে যতদূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। ক্ষেতের ফসল, ঘেরের মাছ– সবই কেড়ে নিয়েছে এই পানি। কেড়ে নিয়েছে মানুষের থাকার জায়গাটুকুও। শতাধিক গ্রামের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, কৃষিজমি এবং মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে। পানির কাছে হেরে যাচ্ছে ভবদহ অঞ্চলের পাঁচ লাখ মানুষ। তাদের অনেকের ঠাঁই হয়েছে মহাসড়কের ধারে, স্কুল বা আশ্রয়কেন্দ্রে, কেউ এলাকা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভিন্ন এলাকায় স্বজনের বাড়িতে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, চার দশকে ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হয়নি। তবে পানি সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, চার দশকে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার, যার সিংহভাগ লুটপাট হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষের কোনো উপকার হয়নি। তাই দ্রুত পানি নিষ্কাশন, জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) চালু ও আমডাঙ্গা খাল সংস্কার জরুরি।
মশিয়াহাটি গ্রামের প্রকাশ মণ্ডল বলেন, ‘এখনও ঘরের মধ্যে জল রয়েছে। উঠানে বাঁশের সাঁকো দিয়েছি। ঘর থেকে সাঁকো দিয়ে বের হচ্ছি। জল আর একটু বাড়লে বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় উঠতে হবে। টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় পানীয় জলের সমস্যা দেখা দিয়েছে।’ ভুক্তভোগীরা জানান, ভবদহ জলাবদ্ধতার কারণে চার দশকের বেশি সময় ধরে তারা ভুগছেন। বিশেষ করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের কারণে মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমান সরকার আমডাঙ্গা খাল সংস্কার ও টিআরএম বাস্তবায়ন করলে স্থায়ীভাবে পানি থেকে মুক্তি মিলবে বলে জানান তারা।
এদিকে উপদেষ্টা ভবদহ এলাকা পরিদর্শনে আসায় আশার আলো দেখছেন দুর্ভোগের শিকার মানুষ। তারা বলছেন, রিজওয়ানা হাসান একদিকে যেমন ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তেমনি সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। দ্রুত এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। ফলে সবাই আশান্বিত।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালি বলেন, উপদেষ্টার নির্দেশে আগেই পানি নিষ্কাশনের কাজ শুরু হয়েছে। এবার উপদেষ্টা ও তাঁর টিম সরেজমিন দেখলেন। এতে আমরা আশার আলো দেখছি। আমরা সরকারের কাছে এর স্থায়ী সমাধান চাই। একই সঙ্গে বিগত সময়ে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পে যে হরিলুট হয়েছে, তা তদন্ত করে জড়িতদের বিচার করার দাবি জানান তিনি।
- বিষয় :
- নদীরক্ষা