ঘুষে নির্ধারণ বোরো বীজের বরাদ্দ
ঘুষ দিলে বরাদ্দ বেশি, না দিলে কিছুই মেলে না

ধান
মোস্তফা কামাল, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৪৪ | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৮:২৮
কিশোরগঞ্জে বোরো বীজ বিতরণে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। কৃষকরা জানান, টাকার বিনিময়ে কোনো উপজেলায় চাহিদার তুলনায় বেশি বীজ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ঘুষ না দেওয়ায় কোনো উপজেলায় এক ছটাকও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
এ অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক (বীজ) এ কে এম মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে। এর আগে তিনি কুষ্টিয়ায় থাকার সময় দুর্নীতির দায়ে প্রায় ১২ বছর বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) ছিলেন। এ কারণে তাঁর পদের কর্মকর্তারা কেউ যুগ্ম পরিচালক, কেউ অতিরিক্ত পরিচালক, কেউ মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি পেলেও মনিরুজ্জামান উপপরিচালকই রয়ে গেছেন।
জেলা বিএডিসি বীজ ডিলার সমিতির সভাপতি সামিউল হক ভূঁইয়া জানান, এ জেলায় ২৬৯ জন ডিলার রয়েছেন।
গত বুধবার শহরের নিউটাউন এলাকার বিএডিসি অফিসে গেলে উপসহকারী পরিচালক ফাতেমা নাসরিন জানান, এবার বিভিন্ন জাতের বীজের নিট প্রাপ্তি ৩ হাজার ২৩ টন ৪৫০ কেজি। বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৪৭৮ টন ৫৬০ কেজি। স্থিতি আছে ১ হাজার ৫৪৪ টন ৮৯০ কেজি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার ১৩ উপজেলায় বিভিন্ন জাতের ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমি। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৯১২ টন চাল। এর মধ্যে ইটনায় আবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা সবচেয়ে বেশি, যথাক্রমে ২৭ হাজার ৪০০ হেক্টর জমি ও ১ লাখ ২৮ হাজার ৫৮৪ টন চাল। অষ্টগ্রামে আবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ২৪ হাজার ১৭০ হেক্টর জমি ও ১ লাখ ১১ হাজার ১৪৭ টন চাল। পাকুন্দিয়ায় আবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ১০ হাজার ৪০০ হেক্টর জমি ও ৪৮ হাজার ৯৪৩ টন চাল।
হাওরবেষ্টিত ইটনায় বিএডিসির ডিলার ২৩ জন। তাদের কয়েকজন জানিয়েছেন, ইটনায় ধানের উৎপাদন বেশি, ফলনের হার বেশি, মানও ভালো। আর হাওরে আগাম বন্যায় ধান বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে সেখানে আগাম জাতের ধানের চাষ বেশি করা হয়। এতদিন হাওরে আগাম জাতের ধান ব্রি-২৮ আবাদ করা হতো। গত কয়েক বছর ধরে নেকব্লাস্ট রোগ দেখা দেওয়ায় এবার এই বীজটি সরবরাহ করা হয়নি। এর বিকল্প হিসেবে আগাম জাতের ধান ব্রি-৮৮ আবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিলার সামিউল হক ভূঁইয়া।
ইটনার কোনো ডিলারকে আগাম জাতের ধান ব্রি-৮৮ ভিত্তি বীজ এক গ্রামও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এই বীজের ধানগুলো বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। অন্যদিকে টান (অপেক্ষাকৃত উঁচু) উপজেলা পাকুন্দিয়ায় ধানের জমি কম, ফলন কম, গুণগত মানও ইটনার মতো নয়। কিন্তু বরাদ্দপত্রে দেখা গেছে, পাকুন্দিয়ার ডিলাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ভিত্তি বীজ ৪০ কেজি করে। ইটনায় প্রত্যেক ডিলারকে আগাম জাতের মান ঘোষিত ধান ব্রি-৮৮ বীজ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪০ কেজি। অন্যদিকে পাকুন্দিয়ায় বন্যা হয় না। সেখানে প্রত্যেক ডিলারকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৭০০ কেজি।
এদিকে পাকুন্দিয়ার ডিলার নওশাদকে তিন লাইসেন্সের বিপরীতে ভিত্তি বীজ ধান ব্রি-৮৮ দেওয়া হয়েছে ১২০ কেজির স্থলে ৫ হাজার কেজি (৫ টন)। এ জন্য ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ঘুষের লেনদেন হয়েছে বলে অন্য ডিলাররা জানিয়েছেন। এ ধরনের বরাদ্দে হাওরের ডিলাররা যেমন ক্ষুব্ধ, আবার ডিলার নওশাদও ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে। কারণ, তিনি উপপরিচালক মনিরুজ্জামানকে ওই টাকা দিয়েছিলেন ৪০ টন ভিত্তি বীজ পাওয়ার জন্য। পাকুন্দিয়ার আরেক ডিলার এরফান মাস্টারকেও ঘুষের বিনিময়ে বরাদ্দপত্রে উল্লিখিত হিসাবের অতিরিক্ত বীজ দেওয়া হয়েছে বলে অন্যরা অভিযোগ করেছেন। আরও একাধিক ডিলারকে ঘুষের বিনিময়ে এ রকম বাড়তি বীজ দেওয়া হয়েছে। এই বীজ ৫৫ টাকায় কিনে ডিলাররা ৬১ টাকায় বিক্রি করেন।
হাওরবেষ্টিত অষ্টগ্রামে প্রত্যেক ডিলারকে ব্রি-৮৮ ভিত্তি বীজ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৪০ কেজি। আর মান ঘোষিত ব্রি-৮৮ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সাড়ে ৫ টন। এখানে একটি শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে বলে ইটনার ডিলাররা দাবি করেন। তারা জানান, অষ্টগ্রামে জমির পরিমাণ ইটনার তুলনায় কম। অষ্টগ্রামের সঙ্গে জেলা সদরের যোগাযোগ ব্যবস্থা এমনই, এসব বীজ নিয়ে এলাকায় যেতে তিনবার যান পাল্টাতে হয়। যে কারণে ডিলাররা এসব বরাদ্দের বীজ নেন না। তারা পাশের হবিগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রয়োজনীয় বীজ সংগ্রহ করেন। তাতে পরিবহন জটিলতা এবং খরচ কমে। এর পরও অষ্টগ্রামের ডিলারদের এত বেশি বীজ দেওয়ার কারণ হলো, তারা এগুলো নেবেন না। পরে উপপরিচালক এসব বীজ ঘুষের বিনিময়ে অন্য ডিলারদের হাতে তুলে দেবেন।
এখন হাওরে বেশি দেওয়া হয়েছে বিলম্বিত জাত ব্রি-২৯ ও ব্রি-৮৯। এগুলো ব্রি-৮৮-এর তুলনায় ২০ দিন বিলম্বে কাটা লাগে। যে কারণে এসব ধান আগাম বন্যার হুমকিতে থাকে। অথচ ভিত্তি ও মান ঘোষিত ব্রি-৮৮ বীজ হাওরের জন্য বেশি দরকার ছিল। এখন ইটনার কৃষকদের বাধ্য হয়ে অন্য স্থান থেকে বাড়তি দামে মান ঘোষিত ভিত্তি বীজ ব্রি-৮৮ জোগাড় করতে হবে।
মোট জমির বিপরীতে ইটনায় আগাম ব্রি-৮৮ জাতের চাহিদা আছে ৪৫ শতাংশ। বিলম্বিত জাতের চাহিদা আছে ২৫ শতাংশ। আর হাইব্রিড বীজের চাহিদা আছে ৩০ শতাংশ। কম চাহিদাসম্পন্ন বীজ কোনো কোনো ডিলারের গুদামে পড়ে আছে।
ডিলাররা আরও জানান, দেশের কোথাও ব্রি-৮৯ বীজের তেমন চাহিদা নেই। অথচ গত বুধবারও বগুড়া থেকে এসব বীজ এনে গুদামজাত করতে দেখা গেছে। এই বীজ ডিলার পর্যায়ে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রির কথা। কিন্তু এসব বীজ বিক্রি না হলে শেষ পর্যন্ত ‘অবীজ’ হিসেবে অনেক কম দামে বেচতে হবে। আর অবীজ বেচার সময় দামে নয়ছয় করার সুযোগ থাকে। ব্রি-৮৮, ব্রি-৯২ ও ব্রি-২৯ জাতের চাহিদা বেশি। সেই কারণে এ তিন জাতের ধান কয়েকজন ডিলারকে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে বেশি পরিমাণে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ইটনায় প্রত্যেক ডিলারকে বিলম্বিত জাত ব্রি-২৯ বীজ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ টন ৬৫০ কেজি করে। অথচ এত বীজ তাদের দরকার নেই। যে কারণে বাড়তি বীজ এখনও গুদামে পড়ে রয়েছে। এভাবে ত্রুটিপূর্ণ বরাদ্দ দিয়ে চাহিদাসম্পন্ন বহু বীজ ঘুষের বিনিময়ে অন্য ডিলারদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। আবার বহু বীজ এখন বিএডিসির গুদামে পড়ে আছে। এসব বীজ চালের ধান হিসেবে কম দামে বিক্রি করতে হবে। এতে একদিকে হাওরের ডিলার ও কৃষকরা বীজের ঘাটতিজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর্থিকভাবে।
ঘুষের বিনিময়ে বাড়তি বীজ বরাদ্দ পাওয়ার বিষয়ে কথা বলার জন্য পাকুন্দিয়ার ডিলার নওশাদকে মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি সংযোগ কেটে দেন। পাকুন্দিয়ার অন্য ডিলার এরফান মাস্টারকে প্রশ্ন করলে তিনি পরে সাক্ষাতে বলবেন বলে জানান।
উপপরিচালক এ কে এম মনিরুজ্জামান ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মূলত গুদামরক্ষক শুব্রামনিয়াম বৈষ্ণব কয়েকজন ডিলারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। যে কারণে তাঁকে পাকুন্দিয়ায় বদলি করা হয়েছে।
তবে শুব্রামনিয়ামকে জিজ্ঞেস করলে তিনি এবং অন্য কেউ টাকা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নন বলে জানান।
এদিকে কয়েকজন ডিলার জানান, উপপরিচালক সরাসরি টাকা নেন না। শুব্রামনিয়ামের মাধ্যমে নেন। কিন্তু ডিলাররা ঘুষ অনুযায়ী পরিমাণমতো বীজ না পাওয়ায় তর্কের মধ্যে বিষয়টি জানাজানি হয়। জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিবও এটি জানতে পারেন। এসব কারণে উপপরিচালক মনিরুজ্জামান নিজেকে বাঁচাতে শুব্রামনিয়ামকে বদলি করেছেন।
জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব এবং জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কিছু অনিয়ম হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, ইটনার কয়েকজন ডিলার তাঁর কাছে গিয়ে নালিশ করেছিলেন। পরে তিনি মনিরুজ্জামানকে বলে কয়েকজনের বরাদ্দ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে মনিরুজ্জামান ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম হবে না বলে কথা দিয়েছেন।
- বিষয় :
- বোরো
- ধান সংগ্রহ